জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে দুটি হত্যা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার রমনার পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর আরিফ গত ২৩ অক্টোবর এই দুই মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে তিনি ডিবি বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেননি। বরং নিজেকে নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ডিবি থেকে কোনো মামলা আদালতে প্রেরণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের সই থাকা আবশ্যক। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ এই নিয়ম এড়িয়ে গেছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে তিনি অসুস্থতার কথা বলে ছুটিতে চলে যান।
দুটি মামলার একটি ১৬ জুলাই নিউমার্কেট এলাকায় সংঘটিত হত্যার ঘটনায় দায়ের করা হয়। ছাত্র আন্দোলনের সময় সবুজ মিয়া ও শাহজাহান মিয়া নামের দুই ব্যক্তি নিহত হন। সবুজকে মারধর এবং শাহজাহানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরদিন নিউমার্কেট থানায় সবুজের চাচাতো ভাই মো. নুরনবী ও শাহজাহানের মা আয়শা বেগম বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৩ আগস্ট আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে আটক করা হয়। ১৬ আগস্ট গ্রেপ্তার হন মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান। মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চেষ্টা ছিল এই তিনজনকে দায়মুক্তি দেওয়ার একটি উদ্যোগ।
তদন্ত কর্মকর্তার সাফাই ও অভিযোগ
ডিবি সূত্রে জানা গেছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জিজ্ঞাসাবাদে পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আরিফ দাবি করেন, তিনি অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সানজিদা আফরিনের নির্দেশে কাজটি করেছেন। তবে সানজিদা এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, “এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই।”
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী এই বিষয়ে সানজিদার কাছে ব্যাখ্যা চান। সানজিদা তার ব্যাখ্যা দিলেও সেটি ডিএমপি কর্তৃপক্ষের কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক জানান, এই ঘটনায় পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আরিফকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি পুরো বিষয়টি পুনঃতদন্ত করা হচ্ছে। রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।”
ডিবি কর্মকর্তারা জানান, এই দুটি মামলার তদন্তে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। মামলার নথিতে দেখা গেছে, চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তারা সাক্ষ্য ও প্রমাণ সংগ্রহে নিয়মিত তদারকি বা অনুমোদনের প্রক্রিয়া মেনে চলেননি।
ডিবির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, “অপরাধীরা যতই প্রভাবশালী হোক, তাদের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত হবে। কোনো ভুলচুক বরদাশত করা হবে না।”
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রচেষ্টা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকে এই ধরনের ঘটনাকে বিচার প্রক্রিয়ায় দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করছেন। অন্যদিকে, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি উঠেছে।
ডিবি বিভাগ নিশ্চিত করেছে, মামলাগুলো পুনঃতদন্ত করা হবে এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি সঠিক নিয়ম মেনেই জমা দেওয়া হবে। কেউ যাতে অন্যায়ভাবে দায়মুক্তি না পায়, সেটি নিশ্চিত করতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনা তদন্ত ও বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে এসেছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়বদ্ধতার বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছে।