বিকল্পধারা বাংলাদেশ নামে বাংলাদেশে রয়েছে একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। এটা হয়তো অনেকেই ভুলে যেতে বসেছে। কারন দলটির অবস্থা এখন বেশ শোচনীয় এবং পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে। এ দিকে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দলটি সাংগঠনিক কোনো কর্মকাণ্ডে নেই। সরকারে আছে, না বিরোধী দলে-তা নিয়েও যথেষ্ট ধোঁয়াশায় দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে দলটির অভ্যন্তরে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, যা এখন চরম আকার ধারণ করেছে। এর জেরে নানা অভিযোগ তুলে সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন দলের প্রভাবশালী নেতা প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রউফ মান্নান। আরও একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ বেশকিছু নেতা পদত্যাগের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। দলীয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এর বাইরে গত জাতীয় নির্বাচনের আগে গঠিত বিকল্পধারার জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ও ভেঙে গেছে। সে সময় ১১টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এই জোট নানা কারণে বেশ আলোচিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ), এনডিপি, জাতীয় জনতা পার্টিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের পর থেকে কোনো কর্মকাণ্ডে না থাকা এবং শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখাসহ বিভিন্ন অভিযোগের বরাত দিয়ে জোট থেকে বেরিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মুখপাত্র মাহী বি. চৌধুরী শনিবার বলেন, ‘দল হিসেবে আমরা এই মুহূর্তে আন্দোলনমুখী রাজনীতিতে নেই। তবে পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন। আমি জনগণের সাথে জড়িত। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দলের অস্থিরতার পাশাপাশি কারও কারও ব্যক্তিগত ক্ষোভ, দুঃখ ও ক্ষোভ রয়েছে।
আমি কি তাদের নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করতে পারি? সূত্র জানায়, গত ৭ আগস্ট বিকল্পধারার সভাপতি ও মহাসচিবের কাছে চিঠি দিয়ে আবদুর রউফ মান্নান প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সাধারণ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের কারণ উল্লেখ করে তিনি চিঠিতে বলেন, আমি মনে করি, বিকাশধারা বাংলাদেশ তার নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। শুধু নামেই বিকল্প, দলটির কোনো সাংগঠনিক কাঠামো নেই, কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই। দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে সব ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন দলের তিন শীর্ষ নেতা।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ কেন্দ্রীয় কমিটির বেশির ভাগ নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। দলের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দলের মুখপাত্র মাহী বি. চৌধুরী দলীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। তাই যেখানে গণতন্ত্র নেই এবং দলের নেতা-কর্মীদের কদর নেই, সেখানে আমি এমন দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই না।
আব্দুর রউফ মান্নান বিকল্পধারায় প্রভাবশালী নেতা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি দলটির প্রতিষ্ঠা থেকে ছিলেন। তার রাজনীতির শুরু ১৯৭৮ সালে জাগদলে যোগদানের মাধ্যমে। পরে ১৯৮৭ সালে নওগাঁর পতœীতলা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নওগাঁ-২ (ধামুইরহাট-পতœীতলা) আসন থেকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই আসন থেকে বিকল্পধারার প্রার্থী ছিলেন।
জানতে চাইলে আব্দুর রউফ মান্নান বলেন, ‘পদত্যাগের কারণ হলো বিকল্পধারার সঙ্গে দল করা যাবে না। বিকল্পধারা সরকারি, না বিরোধী দলে আছেÑতা শীর্ষ নেতারাই বলতে পারছেন না। তাহলে বিকল্পধারা কোথায় আছেÑএ প্রশ্নটা আমাদের।’ তিনি বলেন, ‘দলের দুজন সংসদ-সদস্য সরকারের সমর্থনে বিভিন্ন কাজ করছেন, বিভিন্নভাবে ব্যাংক ঋণও পাচ্ছেন। এসব নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয় সৃষ্টি হয়েছে। তাই সম্প্রতি দলের অনেক নেতা বসে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি শুরু করেছি। শিগগিরই আরও প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ ৩০ থেকে ৪০ জন একযোগে পদত্যাগ করবেন।’
এ বিষয়ে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান যুগান্তরকে বলেন, ‘দলে কোনো অস্থিরতা নেই। প্রতিনিয়ত দলের বৈঠক হয়। আব্দুর রউফ মান্নান যেসব অভিযোগ করে পদত্যাগ করেছেন, তা সঠিক নয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো মহাজোটে আছি। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।’ তিনি মনে করেন, ‘এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি চলছে, এখন রাজনৈতিক অঙ্গনও অস্থিতিশীল হলে তো আরও উত্তপ্ত হয়ে যাবে। আমরা তা চাই না। তবে স্বীকার করছি, আমাদের মাঠে ওরকম দেখা যায় না। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে আমাদের একটা ভ‚মিকা আছে, ছিল এবং সামনেও রাখব। জাতীয় নির্বাচন আরও কাছে আসুক, দেখা যাক তখন কী হয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিকল্পধারার একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, দেশের রাজনীতিতে দলের প্রেসিডেন্ট বি. চৌধুরীর যে ইমেজ রয়েছে, তা দলের মধ্যে আর কারও নেই। তার বয়স হয়েছে, মাঝেমধ্যে অসুস্থও থাকেন। তার ছেলে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মুখপাত্র। তিনিসহ মহাসচিবকে নেতাকর্মীরা কখনো কাছে পান না। এমনকি ফোনেও তাদের পাওয়া যায় না। এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে নানা ইস্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঠে ছিল, এখনো আছে। কিন্তু এই একমাত্র দল (বিকল্পধারা), যাদের মাঠে পাওয়া যায়নি। দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য হিসাবে নেতাকর্মীদের কাছে এসবের জবাবদিহি তাদেরই করতে হয়। এভাবে দল চলতে পারে না।
অবশ্য মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এখন ভালো আছেন। কোভিডের সময়ে তার সঙ্গে দেখা করতে পারতাম না এবং সে সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন। জোটের (যুক্তফ্রন্ট) শরিক দলের নেতারা জানান, ১১টি দল ও কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলেও লাভবান হয়েছে একমাত্র বিকল্পধারা। জোটের অন্য দলগুলোর কথা চিন্তা না করে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিকল্পধারার নেতারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেছে। তারা দুটি আসন পেয়েছে। ক্ষমতাসীন দলও শুধু মাহী বি. চৌধুরী ও মেজর (অব.) মান্নানের দুটি আসনে ছাড় দিয়েছে। অন্য কোনো দলের নেতাদের ছাড় দেয়নি। তখনই এ জোট শেষ হয়ে গেছে। তারপরও কেউ কেউ নির্বাচন-পরবর্তী সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় ছিলেন। কিন্তু তা না পেয়ে সবাই হতাশ। তাই অনেকে জোট ছেড়ে দিয়েছেন। এখন জোট নেই। এদিকে জোট এখনো বহাল আছে জানিয়ে বিকল্পধারার মহাসচিব আবদুল মান্নান দাবি করেন, ‘হয়তো সব দল জোটে নেই। কয়েকটি দল চলে গেছে। কিন্তু তাদের জোট আছে।’
প্রসঙ্গত, এ দিকে বিকল্পধারা নিয়ে আর কোন ধরনের আশাই দেখছেন না রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কারন এই ধরনের ভঙুর দল নিয়ে কোন ভাবেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনিতি করা চলে না।