নিজেকে অতিরিক্ত সচিব পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে সম্প্রতি গ্রেপ্তার হন আব্দুল কাদের নামে এক প্রতারক। তবে গ্রেপ্তারের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক উঠে আসছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। আর এরই জের ধরে এবার জানা গেল, মানুষকে ফাঁদে ফেলতে নারীদের ব্যবহার করে আসছিলেন তিনি।
এছাড়া গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তকারীরা তথ্য পেয়েছেন, তাঁর রয়েছে তিন স্ত্রী। তবে বেশ কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এঁদের কয়েকজন কাদেরের সহযোগী হিসেবে অফিসে কাজ করতেন।
দ্বিতীয় স্ত্রী শারমীন চৌধুরী ছোঁয়াও একসময় তাঁর অফিসে কাজ করতেন। কয়েকজন কথিত মডেলও ছিলেন তাঁর সহযোগী। বিভিন্ন ব্যবসায়ী, ব্যাংকারসহ উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে কথিত মডেলকে দিয়ে ছবি তুলে ব্লাকমেইলিং করতেন তিনি। তবে বিভিন্ন তদবির ও ঋণ পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতারণা করার অভিযোগই বেশি।
কথিত ধনকুবের মুসা বিন শমসেরের প্রতিষ্ঠানের আইন উপদেষ্টা হয়ে ২০ কোটি টাকার লেনদেনের পাশাপাশি সাবেক যুবলীগ নেতা জি কে শামীমকে জামিনের চুক্তি করেন কাদের। ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তারের পর শামীম এখন কারাগারে আছেন।
গতকাল রবিবার মুসা বিন শমসের ছেলে জুবি মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, ‘প্রতারক আব্দুল কাদেরের সঙ্গে প্রতারণায় জড়িত যাঁদের নাম আসছে, তাঁদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। অভিযোগগুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
ডিবির সূত্র জানায়, কাদের দুটি পাসপোর্ট ব্যবহার করছিলেন। একটিতে তাঁর নাম আব্দুল কাদের, অন্যটিতে আব্দুল কাদের চৌধুরী। এসএসসি পাস না করলেও সনদপত্রসহ অনেক জাল নথিপত্র তৈরি করে তিনি মানুষকে বোকা বানিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে কাদের তিনটি বিয়ে করেছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন তাঁর অফিসের কর্মী। আরো কিছু তরুণী ও কথিত মডেলের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগের তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এঁদের তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের ফাঁদে ফেলতে ব্যবহার করতেন। তার বিভিন্ন কাজে এসব তরুণীরা যেত।
সুন্দরী তরুণী ছাড়াও কয়েকজন স্মার্ট যুবক ছিল তার সহযোগী। তাদেরকে তিনি সেনা কর্মকর্তা এবং সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন। মুসা বিন শমসেরের আইন উপদেষ্টা পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি নিজের গড়ে তোলা আটটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের ব্যবহার করতেন তিনি। এতে ব্যবসায়ীরা তাকে বিশ্বাস করত। কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাও তার ফাঁদে পড়েছেন। ভুয়া কার্যাদেশ দেখিয়ে বোকা বানান অনেক দায়িকত্বশীল ব্যক্তিকে। ভিন্ন মানুষের কাছে ভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করতেন তিনি। তবে সাধারণ ব্যবসায়ীদের তিনি অতিরিক্ত সচিব বলেই পরিচয় দিতেন। প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের কাছে অন্তত ৩৩ জন সচিব ও মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিতেন।
এদিকে ডিবি সূত্র জানায়, মুসা বিন শমসেরের মেজো ছেলে আইনজীবী জুবি মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রতারক আব্দুল কাদেরের সঙ্গে মুসা পরিবারের যোগাযোগ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন তদন্তকারীরা। কাদের যোগাযোগে মুসা বিন শমসেরকে বাবা বলে ডাকতেন। চেক প্রদান ছাড়াও তাদের মধ্যে টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে এবং ফ্ল্যাট বিক্রি নিয়ে কথা হয়েছে। তদন্তের ধারাবাহিকতায় মুসা বিন শমসের ও তার স্ত্রীকেও আজ (সোমবার) জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে জানায় সূত্র।
গত বৃহস্পতিবার রাতে আটকের পর তদন্তে কাদেরের ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন ডিবির কর্মকর্তারা। ধারাবাহিক অভিযানে শুক্রবার পর্যন্ত মিরপুর, কারওয়ানবাজার ও গুলশান থেকে কাদেরের দ্বিতীয় স্ত্রী ছোঁয়া এবং শহিদুল আলম ও আনিসুর রহমান নামে দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় একটি অস্ত্র মামলা ও তেজগাঁও থানায় একটি প্রতারণার মামলা করা হয়েছে। দুটি মামলায় আদালতের নির্দেশে কাদেরকে সাত দিনের এবং বাকি তিনজনকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি।
এদিকে ডিবির কর্মকর্তারা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, কাদেরকে আটকের পর পাঁচ ভুক্তভোগী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন জানিয়েছেন, ১০ কোটি টাকা ঋণ পাইয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে ৯০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় কাদের।
এ ঘটনায় কাদেরের উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা। এদিকে তার বিরুদ্ধে আসা এ সকল অভিযোগের আলোকে তদন্তের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।