Friday , September 20 2024
Breaking News
Home / Countrywide / অবশেষে সামনে এলো, সাক্কুর হেরে যাওয়ার পেছনের প্রধান ৩ কারন

অবশেষে সামনে এলো, সাক্কুর হেরে যাওয়ার পেছনের প্রধান ৩ কারন

তিন দিন আগে শেষ হয়ে গেল কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। আর এই নির্বাচনে খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন মনিরুল হক সাক্কু। অপরদিকে নতুনভাবে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হলেন আরফানুল হক রিফাত। তাদের দুজনের ভোটের ব্যবধান মাত্র ৪৩৪ ভোট। এই পরাজয় অনেকটা রিটার্নিং অফিসারের দুর্বলতা এবং অসক্রিয়তার কারণে ঘটেছে, এমনটা দাবি করছেন সাক্কু। তবে সেখানকার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা।

উপনির্বাচনে হেরে গেছেন সাবেক দুই বারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত তাকে হ্যাটট্রিক করতে দিলেন না। মাত্র ৩৪৩ ভোটে হেরে মেয়রের চেয়ার ছাড়তে হলো সাক্কুকে। সাক্কু ফল প্রত্যাখ্যান করে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও সেটি কতটুকু কাজে দেবে সেটিও ভাববার বিষয়।

বিএনপি থেকে আজীবন বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর পরাজয়ের কারণ নিয়ে এখন নগরজুড়ে আলোচনা হচ্ছে। টানা দুই মেয়াদে এই মেয়রের পরাজয়ে পর্দার আড়ালে কী কাজ করছে তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

সূত্রের খবর, এমন ফল আশা করেননি সাক্কু। ভোটকে সামনে রেখে রাজনৈতিক মেরুকরণ যে পাল্টে যাবে তা ভাবতে পারেননি কুমিল্লার রাজনীতিতে ভোটব্যাংকের মালিক ড. বাহাউদ্দিন বাহার এমপি, যার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন, তাকে পরাজিত করতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামবেন, যা সাক্কুরেরও ছিল হিসাব-নিকাশের বাইরে। এর পরেও সাক্কুর দৃঢ়প্রত্যয় ছিল যে নিজস্ব ভোটব্যাংক এবং উন্নয়নের কারণে এই যাত্রায়ও নির্বাচনী সংশয় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে থাকা বিরোধী দলের ‘ষড়যন্ত্রের’ কাছে শেষ পর্যন্ত হেরে যান সাক্কু। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মেয়র পদে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নিজামউদ্দিন কায়সার প্রায় ৩০ হাজার ভোট না পেলে ‘এত কিছুর পর’ সাক্কুরের জয় ঠেকানো যেত না।

সাক্কুরের পরাজয়ের পেছনে তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন তারা। সাক্কুর হেরে যাওয়ার পেছনে মোটাদাগে তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন তারা। প্রথমত বিএনপির সমর্থন না পাওয়া। দ্বিতীয়ত স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহারের চরম বিরোধিতা। তৃতীয়ত বিএনপির একটি অংশ কায়সারকে সমর্থন দেওয়া।

এটি ছিল কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের তৃতীয় নির্বাচন। সাক্কু এর আগে ২০১২ ও ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে দুইবার মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১২ সালের কুসিকের প্রথম নির্বাচনে মোট ১ লাখ ৬৯ হাজার ২৭৩ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দেন ১ লাখ ২৬ হাজার ৭২ জন। ভোট পড়েছে ৮৫.০৬ শতাংশ। মনিরুল হক সাক্কু ৬৫ হাজার ৫৭৭ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী অধ্যক্ষ আফজাল খান পেয়েছেন ৩৬ হাজার ৪৭১ ভোট। ভোটের ব্যবধান ছিল ২৯,১০৬টি।

২০১৭ সালের নির্বাচনে কুসিকে ভোটার ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬। ভোট পড়েছিল এক লাখ ৩২ হাজার ৬৯০। ভোটের হার ৬৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। বিএনপির প্রার্থী সাক্কু ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানার নৌকা প্রতীকে ভোট পেয়েছিলেন ৫৭ হাজার ৮৬৩ ভোট। অর্থাৎ ১১ হাজার ৮৫ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু।

ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী ছিল। তবে সীমা হেরে যায় বিএনপির প্রার্থীর কাছে। এ সময় পরাজয়ের কারণ হিসেবে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে সামনে আনা হয়।

এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত ও সাবেক মেয়র সাক্কু লড়েছেন। এবার ভোটার ছিল ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। ভোট পড়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৭৪৫টি। ভোট পড়েছে ৫৮.৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে রিফাত পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। আর সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। মাত্র ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন রিফাত। তবে ভোটার সংখ্যা কমলেও ভোটার বেড়েছে, গত নির্বাচনের তুলনায় এবার ভোটার প্রায় দুই হাজার বেশি। গত নির্বাচনে সীমা পরাজিত হলেও এবারের চেয়ে প্রায় ছয় হাজার ৫৫৩ ভোট বেশি পেয়েছে নৌকা।

কুমিল্লার সাধারণ ভোটার, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন প্রায় ৩০,০০০ ভোট পাওয়া সাক্কুর পরাজয়ের পেছনে একটি কারন। দুজনই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে সেসব ভোট দুই বাক্সে ভাগ হয়ে গেছে। ধারণা, এভাবে ভোট ভাগাভাগি না হলে অধিকাংশ ভোটই সাক্কুর বাক্সে চলে যেত। সেক্ষেত্রে তার ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট আরও বেশি যোগ করত। বেসরকারিভাবে মেয়র পদে জয়ী আরফানুল হক পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কুমিল্লা জেলা সভাপতি শাহ মো. আলমগীর খান গণমাধ্যমকে বলেন, মূলত বিএনপির ভোট দুইভাগে বিভক্ত হওয়ায় মনিরুল পরাজিত হয়েছেন। মনিরুল যে ভোট পেয়েছেন তার বেশির ভাগই সাধারণ ভোটার। আর বিএনপির বেশির ভাগ ভোট গেছে নিজাম উদ্দিনের বাক্সে।

কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য একিউএম বাহাউদ্দিন আগের দুই নির্বাচনে সাক্কুরের পক্ষে ‘নিরব সমর্থন’ করেছিলেন বলে গু”ঞ্জন রয়েছে। আওয়ামী লীগ তৃতীয় মেয়াদে জয়ী হতে তাদের প্রার্থী পরিবর্তন করেছে।

আফজাল পরিবারের বাইরে গিয়ে বাহাউদ্দিন বাহারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত আরফানুল হক রিফাতকে মনোনয়ন দেয় দল। শুরুতে রিফাত ছাড়া এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৩ জন প্রার্থী ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আফজাল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা ও ছেলে মাসুদ পারভেজ খান ইমরান। পরে সীমা মনোনয়ন ফরম জমা না দিলেও ইমরান প্রার্থী হন। যদি পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন তিনি। তবে অভিযোগ ছিল এই মনোনয়ন প্রত্যাশী এসব নেতা এবং আফজল পরিবার রিফাতের পক্ষে সক্রিয়ভাবে মাঠে ছিল না। তবে এবার বাহাউদ্দিনের পুরো ‘আশীর্বাদ’ পেলেন রিফাত। নানা কারণে আলোচনা-সমালোচনা সত্ত্বেও নির্বাচনের সময় এলাকা ছাড়েননি এই সংসদ সদস্য। তিনি ও তার অনুসারীরা সবাই রিফাতের পক্ষে মাঠে ছিলেন।

এদিকে, আরেক স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের শুরু থেকেই বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের পক্ষে। ফলে ভোটকেন্দ্রে সাক্কুর প্রায় কোনো দলীয় কর্মী ছিল না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে সাক্কুর পরাজয়ের মূল কারণ দলীয় কোন্দল। একই দলের একাধিক প্রার্থী। বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী জোটের সমর্থনের অভাব। দীর্ঘ ১০ বছর মেয়রের চেয়ারে বসে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছেন। তার দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও হা”ম/’লার অভিযোগ। সরকারি দলের সঙ্গে যোগসাজশ।

এছাড়া গত দুই নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রতিশ্রুতি পূরণ করছেন না ড. নগরীর প্রধান সমস্যা যানজট ও জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থতা। টেকসই উন্নয়ন অর্জনে ব্যর্থতা এবং বিগত সরকার দলীয় জোটের সমর্থনের অভাব। এবার সাক্কুর পরাজয়ের নেপথ্যে এসব বিষয় এখন আলোচিত হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, গত দুই নির্বাচনে সাক্কুর জয়ের পেছনে ক্ষমতাসীন দলের শরিকদের ভূমিকা ছিল। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিয়ে সাক্কু যেভাবে বিএনপির দলীয় কোন্দলের সুযোগ নিতে পারেননি আওয়ামী লীগ প্রার্থী রিফাত।

এ ছাড়া বিগত দুটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা। নগরীর প্রধান সমস্যা যানজট ও জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থতা। টেকসই উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হওয়া এবং সবশেষ সরকার দলের মিত্রদের সমর্থন না পাওয়া। সাক্কুর এবারের পরাজয়ের নেপথ্যে এসব বিষয় এখন আলোচিত হচ্ছে।

কুমিল্লা বিএনপির রাজনীতিতে দলের কুমিল্লা দক্ষিণ শাখার আহ্বায়ক আমিন উর রশীদ ইয়াছিনের প্রভাব রয়েছে। তার সঙ্গে সাক্কুর দ্বন্দ্ব পুরোনো। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন যে এলাকায় ডসেই আসনে ইয়াছিন বাহারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২০১৮ সালে ১ লাখ ২ হাজার ৩৫০ ভোট পান। ওই নির্বাচনে ২৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারেন তিনি। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে আর অংশ নেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। পুরো কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকা এই সংসদীয় আসনের অধীনে। আর এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন ইয়াসিনের শ্যালক। এ কারণেই বিএনপি নেতা ও কায়সারের অনুসারীরা নিজেদের ভোটের সবটুকু পেয়েছেন।

কুমিল্লা শহর ও আশপাশের এলাকার বিএনপির রাজনীতিতে তার প্রভাব রয়েছে। এটি সিজারের জন্যও কাজ করেছিল। ইয়াসিন কুমিল্লার একটি বড় শিল্প গ্রুপ লালমাই গ্রুপের মালিক। তার কারখানায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এসব শিল্পের আশপাশে কায়সারও বেশি ভোট পেয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, আমি হারিনি, আমাকে পরিকল্পিতভাবে পরাজয় দেখানো হয়েছে, উচ্চকক্ষের নির্দেশে আমার জয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতার কারণে আমার ফলাফল ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।” এর জন্য দায়ী রিটার্নিং অফিসার। সাক্কু বলেন, ‘দলের ভোট ভাগাভাগি হলেও কুমিল্লার মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে এবং আমি জয়ী হয়েছি। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্বের কারণে ফলাফল করতে পারিনি, আইনি লড়াই করব। “আমার পরাজয়ের পিছনে বিশ্লেষণ সঠিক নয়,” এমনটি বলেন সাক্কু।

বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মোশতাক মিয়া বলেন, “আমরা দলীয়ভাবে এই নির্বাচন বর্জন করেছি। এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের পক্ষে কাজ না করার জন্য নেতাকর্মীদের আগাম নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” তিনি বলেন, আমার দল বিশ্বাস করে এই সরকার ও কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, তাই আমরা এসব নির্বাচন বয়কট করছি।

তবে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে বাহার এর বিপরীতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন সাক্কু। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও সেটাই হবে তার জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেন্জ এবং এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। তবে বিষয়টি প্রত্যক্ষ ভাবে দেখা যাবে নির্বাচনের সময় এবং সেই সময়ের অপেক্ষায় রয়েছেন কুমিল্লাবাসীরা।

 

About bisso Jit

Check Also

আ.লীগ ও তৃণমূল থেকে বিএনপিতে যোগদানের হিড়িক

নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিএনপিতে যোগদানের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *