প্রায় ১৪ বছর মামলা-মোকদ্দমা ও প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে থাকার পর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতি শুরু হয়েছে। গত পাঁচ মাসে ১৯টি উপজেলায় এক হাজারের বেশি সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটি উপজেলার শিক্ষকদের পদোন্নতির কার্যক্রম চলছে। কিন্তু মামলা পিছু ছাড়ছে না প্রাথমিক শিক্ষকদের। মামলা জটিলতায় আটকে আছে দেশের বিভিন্ন উপজেলার প্রায় ১৮ হাজার সহকারী শিক্ষকের পদোন্নতি প্রক্রিয়া। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, দেশের ১৪০টি উপজেলায় প্রকল্পের আওতায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মামলায় আটকে আছে প্রায় ৭ হাজার শিক্ষকের পদোন্নতি। এ ছাড়া ২০১৩ সালে ধাপে ধাপে জাতীয়করণ হওয়া বিদ্যালয়গুলোতে প্রধান শিক্ষকের মামলায় প্রায় ১১ হাজার শিক্ষকের পদোন্নতি আটকে আছে।
এ প্রসঙ্গে ডিপিই মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত আজকের পত্রিকাকে বলেন, ইতোমধ্যে এক হাজারের বেশি সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু মামলা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে বেশ কয়েকটি উপজেলায় প্রধান শিক্ষক পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ কোটি ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯১ জন।
শিক্ষক রয়েছেন ৩ লাখ ৬২ হাজার ৭০৯ জন। জানা যায়, ২০০৯ সালে একটি মামলার কারণে প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদে সারাদেশে পদোন্নতি বন্ধ হয়ে যায়। বছরের পর বছর শূন্য থাকে প্রধান শিক্ষকের বিপুল সংখ্যক পদ। 2014 সালে মামলার নিষ্পত্তি হলেও ওই বছর প্রধান শিক্ষকের পদটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হয়। এতে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি হয় পিএসসির অধীনে। এ ছাড়া সহকারী শিক্ষকদের গ্রেডেশন তালিকা চূড়ান্ত করতে বড় ধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছে। 23 মে 2017 থেকে 30 সেপ্টেম্বর 2019 পর্যন্ত সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদে বর্তমান দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরপর বর্তমান মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত দায়িত্ব নিয়ে বেশ কিছু কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতার জট খুলে দেন।
ডিপিই সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ আগস্ট লক্ষ্মীপুর জেলার সদর, কমলনগর ও রায়পুর উপজেলার ২০১ জন সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির আদেশ জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৯টি উপজেলায় ১ হাজার ৬৩ জন সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
ডিপিইর পদোন্নতি কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মামলার কারণে দেশের বেশ কয়েকটি উপজেলায় পদোন্নতি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বরিশাল বিভাগের ভোলা জেলায় সাতটি উপজেলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি উপজেলায় (মনপুরা ও দৌলতখান) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত করার কার্যক্রম চলছে। আর বাকি পাঁচ উপজেলায় মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় পদোন্নতি আটকে আছে।
এদিকে পদোন্নতি চান না এমন সহকারী শিক্ষকদের তালিকা করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ২৫ মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ কবির উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বলা হয়, পদোন্নতিতে অনিচ্ছুক শিক্ষকদের তালিকাসহ সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ প্রয়োজন। পদোন্নতির মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে নিলে, এটি গুরুত্বপূর্ণ যে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয় যাতে ভবিষ্যতে এটি প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, বা কোনও মামলা না হয়।
ডিপিইর একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি উপজেলায় ১০-২০ জন সহকারী শিক্ষক পদোন্নতি দিতে ইচ্ছুক নন। তবে তালিকা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
এ বিষয়ে ডিপিইর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি উপজেলা থেকে পদোন্নতি পেতে আগ্রহী নয় এমন শিক্ষকদের আবেদন প্রতিদিনই আসছে। 11 ডিসেম্বর পর্যন্ত, 5,000 এর বেশি শিক্ষক তাদের পদোন্নতি পেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
পদোন্নতিতে আগ্রহী নয় এমন পাঁচ শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বয়স, কাজের চাপ ও স্বাস্থ্যের দিক বিবেচনা করে তারা পদোন্নতি নিতে আগ্রহী নন। আবার পদোন্নতি পেলে বেতন খুব একটা বাড়বে না। উল্টো কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। তাই চাকরি শেষে প্রধান শিক্ষকের পদ নিতে আগ্রহী নন তারা।
বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি শাহিনুর আল-আমিন বলেন, “এটা দুঃখজনক যে অনেক বিদ্যালয়ে মামলার জটিলতার কারণে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি হচ্ছে না। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার লিখিত দাবি জানিয়েছি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, একই ধরনের সব মামলা একসঙ্গে নেওয়া হলে এবং একসঙ্গে শুনানি হলে বিষয়টি জট উঠত