পাসপোর্ট একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেশের নাগরিকদের জন্য এটি একটি অন্যতম বড় পরিচয়। আর এই কারনে পাসপোর্ট বানাতে দরকার হয়ে থাকে নানাবিধ তথ্য। তবে বাংলাদেশে এই পাসপোর্ট তৈরী করে যেন একটি বিশাল ঝামেলার কাজ। মানুষকে হতে হয় হয়রানির শিকার। বিশেষ করে পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতির চাকা ঘুরছে। যেন লাগাম টানার কেউ নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ একদিকে কঠোর হলে অন্যদিকে ঘুষের নতুন পথ খুলে যায়। তাই অধিকাংশ পাসপোর্ট অফিসে এখনো ঘুষ বাণিজ্য চলছে।
বেশিরভাগ পাসপোর্ট অফিসে তথাকথিত ‘চ্যানেল মাস্টারদের’ মাধ্যমে প্রতিদিন পাসপোর্ট প্রতি ঘুষ দেওয়া হয়। যার অঙ্ক কয়েক কোটি টাকা। অন্তত ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ হাতে চলে যায়। ঘুষের সদর দপ্তর হিসেবে পরিচিত কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন অন্তত ১০ লাখ টাকা ঘুষ আসে। সরেজমিন অনুসন্ধানে এসব বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের হাত দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ জোরালো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
সরেজমিন কুমিল্লা : ১৮ ডিসেম্বর সকাল ১০ টা। অনুসন্ধান দল কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসে হাজির। সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন। তাই লোকে-লোকারণ্য অফিস স্পেস। প্রধান ফটক থেকে সেবাপ্রার্থীদের দীর্ঘ লাইন। লাইনটা কয়েকটা বাঁক নিয়ে ভবনের বারান্দায় এসে থামল। দুটি কাউন্টারে চলছে আবেদন জমা। নির্দিষ্ট নম্বর যাচাই-বাছাই করে একের পর এক আবেদনপত্র জমা দিচ্ছেন দুজন কর্মচারী। কিন্তু মার্ক না থাকলে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীকে। এমনকি অনেককে লাইনের বাইরে ঠেলে দিচ্ছে আনসার সদস্যরা। অপেক্ষায় থাকা কয়েকজনকে তাদের আবেদনপত্র হাতে নিয়ে দেখা যাচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের ফর্মে আলাদা প্রতীকী সিল রয়েছে। যেমন ‘ঠিকানা’, এজে ২৩, এ+ ইত্যাদি। এগুলি নির্ধারিত ঘুষের মাধ্যমে পাসপোর্ট ইস্যু করার বিশেষ পদ্ধতি।
প্রতিবেদক এই প্রতীকী সীলগুলির রহস্য উদঘাটন করতে ১৯ ডিসেম্বর দালাল চক্রের ডেরায় হাজির হন। তখন সকাল ৯টা। কুমিল্লা শহরের বাগিচাগাঁও। ডায়াবেটিক হাসপাতাল থেকে একটু দূরে নিসা টাওয়ার। এর গলিতে দিনভর পাসপোর্ট প্রার্থীদের ভিড় থাকে। এখানে দোকান খুলেছেন নগরীর শীর্ষস্থানীয় পাসপোর্ট দালাল জাকির হোসেন ওরফে কাজল। দোকানের নাম ন্যাশনাল ট্রেডার্স। ২ রুম সহ অফিস। টেবিলের একপাশে পাসপোর্টের আবেদনের স্তূপ, জাতীয় পরিচয়পত্রের বিক্ষিপ্ত ফটোকপি। অনেকেই কম্পিউটারে বসে সিরিয়ালি ফরম পূরণ করছেন। তাদের কেউ কেউ প্রয়োজনীয় লেনদেনও পরিচালনা করছেন। একজন কর্মচারী বিশেষ চিহ্ন সহ বেশ কয়েকটি আবেদনপত্রের পিছনের পৃষ্ঠাগুলি স্ট্যাম্প করে। এ সময় পাসপোর্ট প্রত্যাশী সেজে কাজলের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। কাজল বলেন, ‘এখানে ফরম পূরণ করা হয়েছে। চার্জ ২০০ টাকা। তবে কেউ ‘চ্যানেল’-এ জমা দিতে চাইলে দেড় হাজার টাকা লাগবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এখানে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের ভিড়ের অন্যতম কারণ কাজল একজন প্রভাবশালী দালাল। তার সঙ্গে কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা জড়িত। বিশেষ করে উপ-পরিচালক নুরুল হুদার সঙ্গে তার দহরম-মহরম ওপেন সিক্রেট। এমনকি অফিসের অফিসিয়াল গাড়িতেও ঘুরে বেড়ায় কাজল। এ ছাড়া নগরীর অন্যতম প্রভাবশালী দালাল শাহজাহান ও তার ভাই ছোটন, নোয়াপাড়ার ইকবাল, মিজান, পল্লব, মিনহাজ, কাশেম, শাহজাহানের ছেলে সজল ও আসিফ, ইসমাইল ওরফে ভাগিনা ইসমাইল (মহিউদ্দিন এন্টারপ্রাইজ) ও আনোয়ার প্রতিনিয়ত মাদক ব্যবসা করে আসছে। অফিস চত্বরে দেখা যায়। নুরুল হুদা মাঝে মাঝে শহরের বিশেষ হোটেলে দালাল কাজলের সাথে নাস্তা করতে আসেন। এমন ঘনিষ্ঠতার কারণ জানতে চাইলে কাজল সাংবাদিকদের বলেন, সে আমার আত্মীয়। নুরুল হুদা তার অপরাধ আড়াল করতে কাজলের মাধ্যমে সমাজের অনেক মানুষকে ম্যানেজ করে।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ডিসেম্বরে কুমিল্লায় ২১ হাজার ১৫৫টি ই-পাসপোর্টের আবেদন জমা পড়েছে। দৈনিক গড় ১ হাজার ৩০০-এর বেশি। এর ৯০ শতাংশই আসে ব্রোকার চ্যানেলের মাধ্যমে। আবেদনের জন্য নির্ধারিত ঘুষের হার ১২০০ টাকা। ফলে দৈনিক ঘুষের পরিমাণ দশ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। প্রতি মাসে ২ কোটি টাকা। এর থেকে ৭০ শতাংশ টাকা নিজের পকেটে রাখেন নুরুল হুদা। বাকি ৩০ শতাংশ অফিসের অন্যান্য কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
সূত্র জানায়, দেশের অন্তত ৩০টি পাসপোর্ট অফিসে এ ধরনের বিশেষ ঘুষের চ্যানেল রয়েছে। কাজলের মতো অনেক প্রভাবশালীও আছেন। অফিস ভেদে চ্যানেলে ঘুষ ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। কুমিল্লা ছাড়াও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়, মুনসুরাবাদ, সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, নোয়াখালী, রাজশাহী, হবিগঞ্জ, গাজীপুর, নেত্রকোনা, নরসিংদী, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও ঢাকায় রয়েছে। চ্যানেল .
চ্যানেল মাস্টার : সাবেক হিসাবরক্ষক মোহাম্মদ আলীম উদ্দিন ভূনা কুমিল্লা অফিসের চ্যানেল মাস্টার ছিলেন, এখন তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন পরিচালক আসমাউল হুসনা ওরফে মাসুদা ও আউটসোর্স কর্মচারী জাফর। এ ছাড়া চট্টগ্রামের মুনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসের নিম্নমানের সহকারী ওমর ফারুক ও সুপারভাইজার শওকত মোল্লা, চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ অফিসের সুপারভাইজার মুস্তাগীর ও সহকারী হিসাব কর্মকর্তা সুমন, নারায়ণগঞ্জে পরিচালক সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিম্নমানের সহকারী নুরুদ্দিন, মুন্সীগঞ্জে অফিস সহকারী নাহিদ, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ফজলে এলাহী, আবেদনকারী ইব্রাহিম খলিল ও গাজীপুরের সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আনিস।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘুষের মাধ্যমে আদায় করা বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই পান সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রধানরা। বাকি টাকা পিয়ন-দারোয়ান ও অফিসের কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এমনকি দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে টাকা ভর্তি প্যাকেট পাঠানো হয় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পাসপোর্টের প্রধান কার্যালয়ে। ব্যক্তিগত বার্তাবাহকের মাধ্যমে সেখানে কর্মরত পরিচালক ও উপ-পরিচালক পদমর্যাদার কয়েকজন কর্মকর্তার ডেস্কে টাকার বান্ডিল সম্বলিত একটি বিশেষ প্যাকেট পৌঁছে দেওয়া হয়। এ ছাড়া স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু সদস্য এবং কুখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিক নামধারী এক শ্রেণীর দালালও ঘুষ গ্রহণ করেন। কিন্তু এসব ঘুষের কোনো সরকারি রেকর্ড নেই। ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহণকারীর স্বার্থ জড়িত থাকায় এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না। যাইহোক, তাদের কারোরই আয় এবং বাস্তব জীবনের সাথে কোন মিল নেই।
সূত্র জানায়, ঘুষখোর চ্যানেলে জড়িত থাকার অভিযোগ ছাড়াও আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে ঝিনাইদহের সাবেক অফিস প্রধান ডিএডি মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে। বিভাগে তিনি দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত। মোজাম্মেল বর্তমানে উত্তরায় ই-পাসপোর্ট পার্সোনালাইজেশন সেন্টারে কর্মরত আছেন।
সূত্র জানায়, গাজীপুরের সাবেক সহকারী পরিচালক মোরাদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ঘুষের একাধিক অভিযোগ এসেছে দুদকের কাছে। বিদেশে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা খরচ করেন। কিন্তু অজানা কারণে তাকে কখনোই তদন্ত করা হয়নি। উল্টো মোরাদ তার কর্মজীবনে প্রাইজ পোস্টিং পেতে সক্ষম হন। নারায়ণগঞ্জে কর্মরত অবস্থায় ঘুষ বাণিজ্যে এক প্রভাবশালী কর্মকর্তার নাম উঠে আসে। কিন্তু স্ত্রী পুলিশ অফিসার হওয়ায় দুর্নীতিবাজ অফিসারকে কেউ গালি দিতে সাহস পায় না। তবে সূত্র জানায়, এ দম্পতির বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
প্রসঙ্গত, পাসপোর্ট অফিস থেকে মানুষের যে পরিমান হয়রানি হতে হয় তার নেই কোন ইয়াত্তা। সরকার বার বার এ নিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করলেও এখনো এ নিয়ে দেখা যায়নি কার্যকরী কোন পদক্ষেপ। দুর্নীতির আখড়া যেন ভাঙতেই পারছে না সরকার।