বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রত্যাশার কথা অব্যাহতভাবে বলে যাচ্ছে। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তীক্ষ্ণ নজর থাকবে দেশটির। দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্বকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শান্তিপূর্ণ উত্তরণে যুক্তরাষ্ট্র জোর দিচ্ছে।
বাংলাদেশ সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার ওয়াশিংটনের এমন অবস্থানের কথা জানিয়ে গেছেন। দুই দিনের সফর শেষে তিনি গতকাল মঙ্গলবার রাতে ঢাকা ছেড়ে যান।
আফরিন আক্তার গত সোমবার সকালে ঢাকায় আসেন। সফরের প্রথম দিন তিনি পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দেখা করেন। এর আগে তিনি সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই মহাপরিচালক ফেরদৌসি শাহরিয়ার ও খন্দকার মাসুদুল আলমের সঙ্গে বৈঠক করেন।
আফরিন আক্তার সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় নাগরিক সমাজের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে চা–চক্রে মিলিত হয়ে মতবিনিময় করেন। গতকাল রাতে ঢাকা ছাড়ার আগে তিনি কক্সবাজারের রো/হিঙ্গা শরণার্থীশিবির ঘুরে আসেন।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আফরিন আক্তারের দুই দিনের সফরে সরকার ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় দুই দেশের সম্পর্কের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। নির্বাচনের বিষয়টি ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে।
আফরিন আক্তার ঢাকা সফরে বেশ স্পষ্ট করেই অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁর সরকারের আশাবাদের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের পাঁচ দফা সুপারিশকে দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন সমর্থন করে।
যুক্তরাষ্ট্র সব দলের অংশগ্রহণে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। এই প্রত্যাশা থেকে তারা বারবার সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কথা বলে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) সমন্বয়ে গঠিত প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল ৮ থেকে ১২ অক্টোবর বাংলাদেশ সফর করে। তারা পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে, যার অন্যতম হলো সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপ।
আফরিন আক্তার মে মাসের পর দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা ঘুরে গেলেন। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের আগে এটিই হতে পারে জ্যেষ্ঠ কোনো প্রতিনিধির শেষ সফর।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে বহুমাত্রিক সম্পর্ককে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়। তাই আফরিন আক্তার ঢাকা সফরের সময় জানিয়ে গেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের আগের তিন মাস এখনকার রাজনৈতিকসহ সামগ্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের তীক্ষ্ণ নজর থাকবে। বাংলাদেশের ঘটনাবলি কোন পথে এগোচ্ছে, তা নিয়মিতভাবে বিবেচনায় নেওয়া হবে।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে তাঁদের অভিমত জানতে চেয়েছেন। এর পাশাপাশি তিনি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কাছে জানতে চেয়েছেন ভিসা নীতির মতো মার্কিন পদক্ষেপ সুষ্ঠু নির্বাচনে কতটা ভূমিকা রাখছে বা রাখবে।
চা-চক্রে উপস্থিত দুই অতিথি দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমকে জানান, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে তাঁরা জনগণের অংশগ্রহণ এবং দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অংশ নেওয়ার ওপর জোর দেন। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতে, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ভোট পাওয়ার হার প্রায় সমান। তাই পছন্দের দল ও প্রার্থী বেছে নেওয়ার সুযোগ জনগণকেই দিতে হবে।
এ সময় আফরিন আক্তার অতিথিদের জানান, যুক্তরাষ্ট্রও চায় জনগণ ভোট দিক। অবশ্যই যেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে তাদের পছন্দ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার যথাযথ সুযোগ থাকে।
চা-চক্রে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচনের বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণকেই ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণের চাবিকাঠি এ দেশের জনগণের হাতে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে, এমনটা যাতে মনে না হয়।
অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে বাংলাদেশ বারবার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছে। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র কেন এ বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে। এ নিয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কূটনীতিক এই প্রতিবেদককে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে অঙ্গীকার নয়, বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখতে চায়। তাই বাংলাদেশ যেন তার অঙ্গীকার যথাযথভাবে পূরণ করে, সে জন্য একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ অব্যাহত রাখছে।
বাংলাদেশে এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এসেছেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে, আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিভাগের সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউ।
এ ছাড়া ভারতে জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। সর্বশেষ গত মাসে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান।
জানতে চাইলে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সব দলের অংশগ্রহণে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। এই প্রত্যাশা থেকে তারা বারবার সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কথা বলে আসছে। এটি যেন হয়, তাই তারা সবাইকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘কাজেই আফরিন আক্তার বাংলাদেশের ওপর তাঁর দেশের তীক্ষ্ণ নজরের কথা বলতে গিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে তাঁদের আকাঙ্ক্ষার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। কারণ, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পথে যে সম্ভাবনাগুলো আছে, তার আলোকে যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত থাকতে চায়।’
হুমায়ুন কবীর মনে করেন, নির্বাচন যদি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও সমৃদ্ধ হবে—এই বার্তাই আফরিন আক্তার দিয়ে গেছেন।