সম্প্রতি বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। ভারতের সহযোগিতা চেয়ে বক্তব্যের কারনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। তবে তিনি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিন্তু দলের মধ্যে ও বিভিন্ন মহলে তাকে নিয়ে অস্বস্তি যেন কাটছে না। প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গি হওয়ার কথা থাকলেও হঠাৎ বাদ পড়ায় আবারও নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে তিনি কি আদৌ দলে থাকবেন কিনা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে তার দল নিয়ে ভারতে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে রয়েছেন; সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন নেই। সোমবার সকাল ১০টার কিছু পরে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিশেষ বিমানটি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দিল্লির উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার পরপরই দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম প্রথম খবরটি অনলাইন ‘ব্রেক’ করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় নানা জল্পনা। যদিও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ব্যক্তিরা জানান, মন্ত্রী শেষ মুহূর্তের অসুস্থতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যেতে পারেননি- এ কথা মানুষ মোটেও বিশ্বাস করছেন না। কারণ সফর শুরুর আগে রোববার বিকেলে তার মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মোমেন সাহেব নিজেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাচ্ছেন বলে নিশ্চিত করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে- মন্ত্রী কি অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন মাত্র কয়েক ঘণ্টার সফর মিস করার? তা ছাড়া মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি অসুস্থ হলে কোথায় চিকিৎসা করা হচ্ছে তা বলতে পারেননি।
এখানে বলা দরকার, প্রধানমন্ত্রী একটি রাষ্ট্রীয় সফরে যাচ্ছেন, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকবেন না, যা নজিরবিহীন। তা ছাড়া এই সফরের আয়োজনের নেতৃত্ব দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মাত্র কয়েকদিন আগে এই অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জনাব মোমেন ভারত সফর করে এসেছেন। মোটকথা, চলমান ভারত সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুপস্থিতি মোটেও স্বাভাবিক নয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারতে যাওয়া বা না যাওয়ার পেছনের কারণ নিয়ে যেসব জল্পনা চলছে, তার মধ্যে প্রধানটি হলো নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তাও এমনটাই মনে করছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানা গেছে। দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে এ ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে কে যাবেন বা কে যাবেন না তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর। শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর নেতিবাচক বার্তা পাওয়ার পর প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও মোমেন বিমানবন্দরে যাননি বলে জানা গেছে। আর প্রধানমন্ত্রীর এমন নেতিবাচক বার্তার কারণ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নানা বিষয়; এর অনেকটা জাতীয় ভাবমূর্তির সঙ্গেও জড়িত- পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বেফাঁস মন্তব্য।
দীর্ঘদিন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আবদুল মোমেন ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। দায়িত্ব গ্রহণের কয়েকদিন পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো। সাধারণভাবে, দুই দেশের মধ্যে সম্মান ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক বর্ণনা করতে মন্ত্রী বলেন; নিঃসন্দেহে কিন্তু বিশেষ করে বাংলাদেশে বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে, জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে বিদ্যমান ভারত-বিরোধী মনোভাব এবং অন্য কিছু কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রাখলে এ ধরনের মন্তব্য যথাযথ হবে না। আরও বড় কথা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুধু আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতেই নয়, এশিয়ার সমাজ-সংস্কৃতিতেও অসম। আরও স্পষ্ট করে বললে, এই ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে সবসময় স্বামীর অধীনস্থ বলে মনে করা হয়। ফলে মোমেন সাহেব ওই মন্তব্য করার পর প্রশ্ন উঠেছে, কে স্বামী আর কে স্ত্রী? মোমেন সাহেবের কথায় বাংলাদেশের মতো ছোট দেশের ওপর ভারতের আধিপত্যের স্বীকৃতি আছে বলেও কেউ কেউ মনে করেন।
এরপর আমেরিকা যখন র্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন মোমেন সাহেব এক অদ্ভুত কথা বললেন। তিনি বলেছিলেন যে আমেরিকায় ‘৪.৫ মিলিয়ন ভারতীয় হিন্দু’ রয়েছে, তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। আমরা ভারতকে বলেছি র্যাবের ওই অবরোধ তুলে নিতে তাঁদেরকে কাজে লাগাতে। এটা অদ্ভুত কারণ আমেরিকায় বসবাসকারী সকল ভারতীয় হিন্দু নয়; এছাড়াও রয়েছে শিখ, মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষ। আর মোমেন সাহেব কেন শুধু হিন্দুদের কথা বললেন? তবে ছাত্রজীবনে তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের গভর্নর মোনেম খানের ঠ্যাঙ্গারে দল এনএসএফ-এর সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টি অনেকেই সামনে এনেছিলেন। আরও বিরক্তিকর বিষয় হল, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ঠিক সেই সময়েই বাংলাদেশে এসেছিলেন; সাংবাদিকরা এ বিষয়ে জয়শঙ্করকে প্রশ্ন করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদের ‘যিনি এ বিষয়টি বলেছেন তাঁকেই প্রশ্নটি করুন’ বলে পাশে দাঁড়ানো মোমেন সাহেবের দিকে বল ঠেলে দেন।
গত ১৮ আগস্ট জন্মাষ্টমী উপলক্ষে চট্টগ্রামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জনাব মোমেন যা বলেছিলেন তা ছিল সবচেয়ে বি/ধ্বংসী। সেখানে তিনি বলেন, তিনি ভারতে গিয়ে সেখানকার কর্মকর্তাদের বুঝিয়েছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় শেখ হাসিনার থাকতে হবে; এর জন্য যা করা দরকার ভারতের তা করা উচিত। বিশেষ করে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমালোচকরা সব সময় অভিযোগ শেখ হাসিনা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারছেন ভারতের সমর্থনের কারণে।
উল্লেখ্য, মোমেন সাহেবের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তার কথায় বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে। আগস্ট মাসে শোকের সময় শেখ হাসনিয়া সাধারণত কোনো নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে চান না বলেও জানানো হয়। তাই চলতি মাসের শেষ দিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ্যের ফয়সালা হতে পারে।প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর থেকে মোমেন সাহেবের বাদ পড়াটা কি মন্ত্রীসভা থেকেও ঝরে পড়ার ইঙ্গিত বহন করছে?
প্রসঙ্গত, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারনে সরকার একটি অস্বস্তিতে পড়েছে যা সফর থেকে বাদ পড়ায় তার প্রমাণ। কিন্তু নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে সত্যই কি তিনি বাদ পড়ছেন।