নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার এক দম্পতি তীব্র অভাবের মুখে পড়ে তাদের সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকে মাত্র ৩০ হাজার টাকায় অন্য আরেকজনের নিকট বিক্রি করে দিয়েছেন বলে জানা যায়। এ ঘটনা সত্য কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে গিয়ে বের হয়ে এলো ভালোবেসে বিয়ে করা দম্পতির নিদারুণ কষ্টের এবং করুন জীবনের গল্প। দেশের অনেক মানুষ কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন যাপন করে, এই দম্পতির জীবনের কাহিনী দিয়ে সেটা স্পষ্ট হলো।
গত রোববার রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল মাহনা এলাকায় লোকজনে কাছে গিয়ে ‘বাচ্চা বিক্রির’ খোঁজখবর নিলে তারা আম্বিয়া হকের বাড়ি দেখান। ওই বাড়িতে ভাড়া নিয়ে থাকেন স্বপন মিয়া ও হালিমা আক্তার দম্পতি। সেখানকার বাসিন্দাদের দেখানো ঠিকানায় তাদের পাওয়া যায়। টিনের ঘর ভিতরে অন্ধকার। ঘরের আসবাবপত্র ছোট চৌকি আর কাঠের বেঞ্চ। সেখানে হালিমা শরীর কুঁকড়ে যন্ত্রণায় শুয়ে আছেন। উপরে একটি ছোট ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানে বাতাসের চেয়ে শব্দ বেশি। ঘরের চারপাশে দড়িতে কাপড় ঝুলছে। কাঠের বেঞ্চে ভাজা ভাত। হালিমার পায়ের নিচে কিছু ওষুধ আর লেবু। ঘরে অপরিচিত কাউকে দেখে উঠে বসতে চায় হালিমা। কিন্তু শরীর পারছে না।
ততক্ষণে বাড়িতে আসেন হালিমার স্বামী স্বপন মিয়া। সঙ্গে তিন সন্তান। দুপুরে খাওয়ার কিছু নেই। দোকান থেকে ২০ টাকার চিড়া ও ১০ টাকার গুড় কিনলেন। তিন সন্তান এক প্লেটে সেগুলো খায়। তিৎি ছোট সন্তান তাৎক্ষণিকভাবে এটি শেষ করে।
কথায় কথায় স্বপন জানান, তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। হালিমার বাবার বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরায়। প্রেম করে দুজনের বিয়ে হওয়ার পর স্বপনের পরিবার সম্মতি দেয়নি। এরপর থেকে স্বপন হালিমার বাড়িতে থাকতেন। সেখানে তিনি রিকশা চালাতেন। তিন সন্তানের জন্মের পর পাঁচজনের সংসার আর রিকশা চালিয়ে আর চলছিল না। কাজের সন্ধানে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে এসেছেন স্বপন-হালিমা দম্পতি। দুই হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নেন। আট হাজার টাকা বেতনে একটি প্রিন্ট কারখানায় কাজ শুরু করেন স্বপন। ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না। কিন্তু ক্ষুধা আর চুপ করে নেই। একেবারে না খেয়ে সে চাকরি ছেড়ে দেয়। দুই মাস তিনি দিনমজুরের কাজ করেছেন যখনই পারেন। এ কাজ থেকে আয়ে সংসার চলে না। তিন মাসের ভাড়া বকেয়া। মালিক বাড়ি ছাড়ার তাড়াহুড়া করছে। অভাবের সংসারে তিনি তার গর্ভবতী স্ত্রীকে পুষ্টিকর কিছু খাওয়াতে পারেননি।
সন্তান বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে হালিমা বলেন, ‘সন্তানেরা হলো হৃদয়ের ধন। গরু–ছাগল না। বেচি নাই। অভাবের জন্য একজনকে দিয়ে দিছি।’ হালিমা দাবি করেন, গত শনিবার মধ্যরাতে তাঁর প্রসবব্যথা শুরু হলে ধাত্রীর খোঁজ করা হয়। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। তাদের কাছে হাসপাতালে যাবে গাড়ি ভাড়া দেওয়ার মতো টাকা নেই। তীব্র যন্ত্রণার সময় তিনি স্বাভাবিকভাবেই একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। ভোরে এক অচেনা দম্পতি এসে নবজাতককে লালন পালন করতে নিয়ে যায়।
স্বপন জানায়, অপরিচিত পরিচয়ে রিকশা গ্যারেজে গেলে কেউ তাকে রিকশা দেয় না। কেউ ধার দেয় না। প্রতিদিন কাজ পাওয়া যায় না। ফলে প্রতিদিনের খাবার পেতে তাদের অনেক অসুবিধা হয়। তখন হালিমা বলেন, ‘কোনো সময় ডাইল–আলুর ভর্তা, আবার কোনো সময় খালি লবণ দিয়া ভাত দিই বাচ্চাগো। খিদায় যখন কান্দে, তখন মারি। মারলে কানতে কানতে ঘুমাইয়া যায়।’
প্রতিবেশী মোসা. স্মৃতি বলেন, ‘রবিবার সকালে হালিমার স্বামীর ডাকে এসেছি। বাড়িতে গিয়ে দেখি একটি তোয়ালেতে জড়ানো র’ক্তমা”খা ছোট সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তান। তখনও নাড়ি কাটেনি। আর রক্তাক্ত হালিমা যন্ত্র”ণায় কাতরাচ্ছে। হালিমা অপরিচিত, অপুষ্টিতে ভুগছেন। রাতে কোনো ধাত্রী আসার সাহস করেনি। পরে সন্তানটির পালস নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম। কষ্ট দেখে ওষুধ ও লেবু কিনলাম।
স্বপন-হালিমার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আইয়ুব আলী নামে এক ব্যক্তি জানতে পেরে সাভার থেকে একটি পরিবার এসে নবজাতক মেয়েটিকে নিয়ে যায়।
নবজাতককে নিয়ে যাওয়া আকরাম হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তিনি সাভারের একটি পোশাক কারখানায় মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। ১১ বছরের সংসারে কোনো সন্তান নেই। আকরাম বলেন, ‘আমার নিজের একটি মেয়ে পেয়েছি। সময়–সুযোগ কইরা কাগজপত্র কইরা নিমু।’
স্থানীয় এক সাংবাদিক হালিমাকে হাসপাতালে ভর্তির উদ্যোগ নেন। হালিমাকে বর্তমানে রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। ওই হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার নাজমুল হাসান বলেন, হালিমা অপুষ্টিতে ভুগছেন। সে হয়তো অনেকদিন ধরে পর্যাপ্ত খাবার পায়নি। আমরা তাকে ডাবল মিল দিচ্ছি।’
ওই ব্যক্তির স্ত্রী হালিমার চিকিৎসক নাজমুল হাসান তার স্বাস্থ্যগত বিষয়ে বলেন, সন্তান প্র’সব কালীন হালিমার জরায়ু বাইরে বেরিয়ে আসে। হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানিয়েছেন তার স্বাস্থ্য বিষয়ে বড় ধরনের কোন ঝুঁকি আর নেই। আগামীকাল মঙ্গলবার হালিমার বেশ কিছু স্বাস্থ্য বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি, যার কারণে তার একাকী সন্তান প্রসবের বিষয়টি ছিল অনেক অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।