দেশের একটি অন্যতম দুর্নীতির স্থান হল জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়। যেখানে নানা ধরনের প্রতার’ণার শিকার হয়ে থাকেন জমি ক্রেতারা। তবে বর্তমান সময়ে জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে দুর্নীতি কিছুটা কমে আসলেও অনেকেই প্রতারিত হচ্ছে। এবার প্রতারণার শিকার হলেন এক নারী। বসবাসের শেষ সম্বল বসতভিটা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন গনভবনের গণভবনের সামনে গিয়ে শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মহনন করার চেষ্টা করেছেন।
তার নাম শিরিন খান। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে গণভবনের উত্তর পাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কেরোসিন ঢেলে ৩ বছর বয়সী মেয়েকে কোলে নিয়ে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। উদ্ধারের পর শিরিন খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিরাপত্তা বাহিনী। এই ৩৫ বছর বয়সী মহিলা বলেছেন যে, তিনি প্রতা”রণার কারণে তার একমাত্র সম্বল হারাতে চলেছেন। কোথাও তিনি ন্যায়বিচার পাননি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান। বাস্তুভিটা রক্ষা না হলে আত্মহনন করুন।
শিরিন খানের বাবার বাড়ি বরিশালের চরমোনাই। শ্বশুর বাড়ি ছিল ঢাকার মাতুয়াইলে। ৮ বছর আগে মাতুয়াইলে সামান্য জমি বিক্রি করে ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের কাছে সুতালারায় ৬ শতক জমি কিনেছিলেন। সেখানে তিনি একটি দোতলা বাড়ি তৈরি করেন। আট মাস আগে উচ্ছেদ নোটিশে তিনি জানতে পারেন জমিটি বেসিক ব্যাংকের কারওয়ানবাজার শাখার বন্ধক সম্পত্তি। ঋণ আদায়ে নিলামে জমি বিক্রি করতে চায় ব্যাংক।
বসতবাড়ি হারালে অসুস্থ স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই। নিজ বাড়ি রক্ষায় গত রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার আশায় গণভবনের সামনে আসেন তিনি।
শিরিন খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তার স্বামী জুনায়েদ আহমেদ খান লিভারের রোগী। শাশুড়ি বারডেম হাসপাতালে ভর্তি। তাদের চিকিৎসার টাকা নেই। ব্যাংক থেকে জমি খালাস করার আশ্বাস দিয়ে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় স্থানীয় দালালরা। আরও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। দুইটি বাড়ি ভাড়া দিয়ে মাসে ১২ হাজার টাকা আয় হয়। এ টাকা দিয়ে স্বামী ও শাশুড়ির চিকিৎসা, ১৫ বছরের মেয়ে ও ১২ বছরের ছেলের লেখাপড়ার খরচ ও সংসার চালান। বিলাপ করে তিনি বললেন, ‘মরে গেলে, দুধের মাইয়্যা কারে মা ডাকব? মাইয়্যাডারে ভালো খাওন দিতে পারি না।’ শিরিন খান জানান, স্থানীয় আব্দুল হান্নান ওরফে হান্নান সৌদি থেকে জমি কিনেছেন। মধ্যস্থতা করেন আয়েস আলী ভূঁইয়া নামে আরেকজন। সোনারগাঁও বৈদ্যেরবাজার ভূমি অফিসে করা দলিলের সাক্ষী ছিলেন স্থানীয় ফজলুল হক ও সালাম শিকার। জমির আসল দলিল ব্যাংকের কাছে বন্ধক ছিল জেনেও তারা জাল দলিল করে জমি বিক্রি করে। ব্যাঙ্ক বলেছে, বর্তমান মৌজা হারের সমান টাকা দিলে তারা দলিল দেবে।
ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা সম্পত্তি কীভাবে বিক্রি করলেন- এমন প্রশ্নে হান্নান সৌদি বলেন, শিরিনের কাছে বিক্রি করা ৬ শতাংশ সম্পত্তিসহ আশপাশের আটটি প্লটের আটটি প্লটের মালিক জহিরুল ইসলাম জয়। ২০১২ সালে জমি বিক্রি করার জন্য জয় তাকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দেয়। সেই ক্ষমতায় তিনি শিরিনের কাছে জমি বিক্রি করেন। কিন্তু জানা যায়নি- জয় আগেই এসব জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এরপর জয় বিদেশে চলে যায়। শিরিনের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। শিরিন খান বলেন, বিচার চাওয়া হলে আয়েস আলী তার নামে চাঁদাবাজির মামলা করেছেন। সোনারগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক রাজু আহমেদ বলেন, এটা কোনো মামলা নয়; একটা সাধারণ ডায়েরি ছিল। কিন্তু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তদন্তে পাওয়া গেছে শিরীন খানই ভুক্তভোগী।
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আবদুল হাই বাচ্চুর চেয়ারম্যান থাকাকালে বেসিক ব্যাংকে অনেক ঋণ জা”লিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৫৬টি মামলা করেছে দুদক। স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই সময় অপর এক ব্যক্তির মালিকানাধীন জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেন জয়। পরে শিরিন খানের মতো সাধারণ মানুষ তা কিনে সমস্যায় পড়েন।
গণভবনের নিরাপত্তা বাহিনী শিরীন খানকে শেরেবাংলা নগর থানায় হস্তান্তর করেছে। রাত ৯টার দিকে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তিনি তার সন্তানকে নিয়ে থানায় বসে রয়েছেন। তার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে- ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার রুবাইয়াত জামান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ১১ টা ১৫ মিনিটের দিকে পুলিশ মেরিনাকে ছেড়ে দেয়।
উল্লেখ্য, শুধু শিরিন খানের মতো অসহায় নারীরা নয়, অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়ে তাদের শেষ আশ্রয় স্থল টুকু হারিয়েছেন। প্রতারণার শিকার হয়ে বাংলাদেশের এখনো অনেক পরিবার ভাসমান অবস্থায় রয়েছেন। যাদের নেই কোনো স্থায়ী ঠিকানা। শুধুমাত্র ঘর ভাড়া করে জীবন পরিচালনা করছেন। জোর করে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ এবং বিভিন্নভাবে জাল দলিলের মাধ্যমে শেষ আশ্রয় স্থল হারাতে হয়েছে অনেক পরিবারকে। সরকারের এদিকটায় নজর দেয়া অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।