এর আগেও বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফরে আসে পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দল। তবে সম্প্রতি এবার তাদের সফরকে কেন্দ্র করে সারাদেশজুড়ে যে সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে, তা হয়তো কোনো কালেই হয়নি। আর এর শুরুটা হয় মিরপুরে অনুশীলনে নামার প্রথম দিন থেকেই। এরপর প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই পাকিস্তানকে সমর্থন করতে দেখা যায় বাংলাদেশিদের অনেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি সমর্থকদের প্রতিহত করতে মিরপুরে মিছিল শুরু করে বাংলাদেশি সমার্থকরা।
তবে এবার সেই পাকিস্তান ক্রিকেটের বাংলাদেশি সমর্থকদের পক্ষে কথা বলায় সরকারি দলের সদস্যদের তোপের মুখে পড়েছেন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ।
শনিবার (২৭ নভেম্বর) একাদশ জাতীয় সংসদের পঞ্চদশ অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে হারুন অভিযোগ করেন, পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দেশটির প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করা হয়েছে।
হারুনুর রশীদ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হচ্ছে। পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশ। পাকিস্তান ক্রিকেট টিম বাংলাদেশের সঙ্গে খেলছে। বাংলাদেশ যাই খেলুক না কেন, পাকিস্তানের সমর্থকেরা তাদের পতাকা উড়াচ্ছে। এটাকে কেন্দ্র করে একটা বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। মনে রাখতে হবে, তারা কিন্তু আমাদের দেশে মেহমান, অতিথি। আমাদের দেশের ক্রিকেট, আমাদের দেশের ফুটবল, আমাদের দেশের মেয়েরা সারা পৃথিবীতে খেলছে। সেখানে পতাকা ওড়ে না বাংলাদেশের?
তিনি বলেন, সেদিন একজন সদস্য দেখলাম বিভিন্নভাবে বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলেছেন।
এ সময় সরকারি দলের সদস্যরা হইচই করে হারুনের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
হারুন বলেন, পাকিস্তান টিমতো আসার দরকার ছিল না। পাকিস্তানি টিমকে কেন খেলতে দিয়েছেন? খেলতে দিতেন না। দরকারই ছিল না। আপনিতো তাদের অনুমতি দিয়েছেন। তারা এখানে এসেছে। এটি ঠিক নয়, একটি দেশের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ ঠিক নয়। এটি আমাদের জন্য সম্মানের নয়, গৌরবের নয়।
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করে হারুন বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, অতীত থেকে মুখ ফিরিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গেও নতুন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি। অতীতের তিক্ততা দূর করতে কোনো প্রচেষ্টা থেকে নিবৃত্ত হইনি। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শন করে উপমহাদেশে শান্তি সহযোগিতার নতুন ইতিহাস রচনা করেছি।
এ সময় সরকারি দলের সদস্যরা হট্টগোল করলে হারুন স্পিকারের কাছে ‘প্রোটেকশন’ চেয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে কথা বললাম, এখানেও যদি বাধা দেন তাহলে আর কী বলব মাননীয় স্পিকার। আমি এমন কিছু বলিনি, আমি ওনার ভাষণ পড়ে শুনিয়েছি।
এরপর হারুন যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মোমিন তালুকদারের প্রসঙ্গ টানেন।
কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে হারুন বলেন, সাক্ষী আলামত ছাড়া কাউকে হত্যা করা একেবারে গুনাহর কাজ। অষ্টম ও একাদশ সংসদের সদস্য আব্দুল মোমিন তালুকদার, তার বয়স তখন (১৯৭১ সালে) ১৮ বছর ছিল। উনি রাষ্ট্রপতির সাথে ২০১১ সালে জাতিসংঘের কনভেনশনে গিয়েছেন।
এ সময় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, মাননীয় সদস্য, আপনি এখানে বিচারের বিষয়ে কথা বলতে পারেন না। বিচার হয়েছে..আপনি বসুন।
পরে তার মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সরকারি দল ও শরিকদের অনেকেই হারুনের বক্তব্যের জবাব দিতে ফ্লোর চাইলে স্পিকার প্রথমে বিরোধী দলীয় প্রধান হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাকে ফ্লোর দেন। যদিও রাঙ্গা সড়কের ইস্যু নিয়ে কথা বলেন।
পরে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে হারুনের বক্তব্যের জবাব দেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ যেভাবে পাকিস্তানের পক্ষে অবলম্বন করে সংসদে কথা বললেন, এতে তার প্রকৃত চরিত্র বেরিয়ে এসেছে। তারা যে রাজাকার, আলবদর, আল শামসের পক্ষে কথা বলছে এবং রাজনীতি করছে; তারা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন না, সেটা প্রমাণিত হয়েছে।
খালিদ মাহমুদ বলেন, জাতির পিতাকে হত্যার পরে জিয়াউর রহমান হত্যাকারীদের শুধু লালনপালনই করেনি, পাকিস্তানি ধারা বাংলাদেশে প্রবর্তন করার জন্য সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চরিত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। একই ধারাই তারা এখনও রাজনীতি করে যাচ্ছে। তার প্রমাণ আজকে হারুনুর রশীদ সংসদে উপস্থাপন করলেন।
নৌপ্রতিমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান অপরাধ করেছে। বঙ্গবন্ধু শান্তিকামী মানুষের নেতা ছিলেন, তার সেই অহিংস ও শান্তিকে বিকৃত করে সংসদে উপস্থাপন করার চেষ্টা হচ্ছে।
খালিদ মাহমুদ বলেন, তারা মনে করেছিল যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে না। এই বিচার হওয়ায় তাদের সেই মনোকষ্ট ফুটে উঠছে। তার (রাঙ্গার) বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে। তাদের সঙ্গে অনেক অমীমাংসিত বিষয়ের সুরাহা হয়নি। তার মানে এই নয় যে, সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশ সরে গেছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে বাংলাদেশকে অন্ধকারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের গর্ব ও অহংকারের জায়গায় ফিরে গেছে বাংলাদেশ। এটাই হচ্ছে বিএনপি ও হারুনুর রশীদদের কষ্ট। আমরা তাদের কষ্ট ও দুঃখ বুঝি। কিন্তু সেই জায়গায় বাংলাদেশ আর কখনো ফিরে যাবে না।
এদিকে সম্প্রতি লক্ষ্য করা যায়, পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সমর্থন করায় রীতিমতো নানা বিপাকে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশিদের অনেককে। এমনকি মারধরের শিকার হতে হয়েছে বলে দাবি করেছেন অনেকেই। এছাড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের পাকিস্তানি জার্সি পরে মাঠে আসতে দেয়া হচ্ছে না বলেও জানা গেছে।