Thursday , November 14 2024
Breaking News
Home / Exclusive / সংকটের মধ্যেও লবিস্ট নিয়োগ করে ডলার খরচ করছে সরকার, মিলেছে মাঝারি কর্মকর্তার সাক্ষাত

সংকটের মধ্যেও লবিস্ট নিয়োগ করে ডলার খরচ করছে সরকার, মিলেছে মাঝারি কর্মকর্তার সাক্ষাত

বাংলাদেশে এখন চলছে বড় ধরণের অর্থনৈতিক সংকট। আর সেই সাথে দেশে দেখা দিয়েছে ডলারের সংকটও। আর এই কারনে ডলার বাঁচাতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এ কারণে জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে পণ্য আমদানি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কাঁচামাল, পণ্যের ভারী যন্ত্রাংশ আমদানির জন্যও অনেক ব্যাংক ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছে না। কিছু ব্যাংক এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছে। ডলার বাঁচাতে সরকারি খরচে কর্মকর্তাদের সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে এত কিছুর পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিআর ও লবিস্টদের পেছনে ডলার খরচ করতে ছুটতে পারছে না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

যুক্তরাষ্ট্রের আইন অফিসের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এ বছর শুধু বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট হিসেবে কাজ করছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। এই বছরের জানুয়ারিতে, নেলসন মুলিনস রিলে অ্যান্ড স্কারবোরো এলএলপি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিযুক্ত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে সংস্থাটির সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। চুক্তি অনুযায়ী, নেলসন মুলিনস ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে সেবা দেবে। এ জন্য সরকারকে মাসে কমপক্ষে ২০ হাজার ডলার খরচ করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশের স্বার্থে নেলসন মুলিন্সকে কোথাও যেতে হলে সে খরচও বহন করবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন কংগ্রেসের একাধিক কর্মকর্তাসহ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ড. শাহরিয়ার আলমের মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন নেলসন মুলিন্স। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক বর্তমান ও সাবেক কূটনীতিক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কূটনীতিক বলেন, কংগ্রেসের সদস্য হলেও একটা জিনিস ছিল। কংগ্রেসের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকের জন্য যদি আপনাকে লবিস্ট নিয়োগ করতে হয়, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দূতাবাস রাখার জন্য এত ডলার ব্যয় করে কী লাভ? তাদের ক্ষমতা কি?

এদিকে, নেলসন মুলিনস থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এই বছরের মার্চে বিজিআর পাবলিক রিলেশন্স, আরেকটি ইউএস পিআর এবং লবিং ফার্ম নিয়োগ করেছে। বিজিআর নিয়োগ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে। রাষ্ট্রদূত সরকারের পক্ষে বিজিআরের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সংস্থার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, সংস্থাটি চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত এক বছরের জন্য বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে। এর জন্য বাংলাদেশকে প্রতি মাসে ২৫ হাজার ডলার দিতে হবে। এর সাথে, ফটোকপি সহ অন্যান্য খরচের জন্য প্রতি মাসে $ ২০০ ছাড়াও, বিজিআর যদি বাংলাদেশে কাজের জন্য বিদেশ ভ্রমণ করে, সেই খরচগুলিও সরকার পরিশোধ করবে।

বর্তমানে আমেরিকান লবিস্ট বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করছেন বলে নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ কে আব্দুল মোমেন। ডলার সংকট ও সঞ্চয় নিয়ে সমকালকে তিনি বলেন, ‘আমাদের ডলার সংকট নেই। ডলারের সংকট কে বলল? ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে ডলারের রিজার্ভ ছিল প্রায় তিন বিলিয়ন। এখন ডলারের রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন।

ডলার সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ডলার সংকট আছে এটা একটা প্রতারণা। আমার কোন (ডলার) সংকট নেই। আমি (বাংলাদেশ) যে ডলার খরচ করি তাও আয়। আমার কাছে ৬০ মাস বা পাঁচ বছরের রিজার্ভ আছে। সেই সাথে প্রতিনিয়ত আয় পাচ্ছি। তুমি বলতে থাকো এগুলো ভুয়া।’

লবিস্টদের পেছনে ডলার খরচ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এগুলো খুবই সামান্য পরিমাণ অর্থ। এর দাম দুই হাজার ডলারের মতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বাংলাদেশ দূতাবাস রয়েছে, যা দেশে বাংলাদেশের পক্ষে একটি বড় লবিস্ট। বাংলাদেশ কাজের ভিত্তিতে লবিস্ট নিয়োগ করে। একটি চাকরি এলে চাকরি ভেদে ৫ হাজার বা ১০ হাজার ডলার খরচ করে। যে মাসে কাজটি করা হয় সেই মাসে এই পরিমাণ খরচ হয়। বাংলাদেশ সারা বছর লবিস্টদের পেছনে টাকা খরচ করে না। আর এতে খুব কম টাকা খরচ হয়। অনেক সময় বেসরকারি ব্যক্তিরা এই টাকা দিলে বাংলাদেশের করদাতাদের টাকা খরচ হয় না।

চলতি বছরের মার্চে সরকারের তরফে আরও তিনটি মার্কিন লবিং সংস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি হল নুরনবার্গার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। তবে এই প্রতিষ্ঠানটি সরকার কর্তৃক সরাসরি নিয়োগ হয়নি। নেলসন মুলিনস সরকারের পক্ষ থেকে এই কোম্পানিকে নিয়োগ দেন। যে কোম্পানিকে মাসে অন্তত ৫ হাজার ডলার দিতে হয়। একইভাবে, পটোম্যাক স্কয়ার গ্রুপও বাংলাদেশ সরকারের জন্য নেলসন মুলিনস নিয়োগ করেছে। ১৫ আগস্ট থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত কাজ করার জন্য সংস্থাটিকে কমপক্ষে $ ২০,০০০ দেওয়া হয়েছে।

আর আইস মিলার এলএলপিকে ৩৬ মাস বা তিন বছরের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। কোম্পানির নিয়োগকর্তা হলেন ক্ষমতাসীন দলের ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী। চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানিকে বছরে ১ লাখ ৬২ হাজার ডলার প্রদান করা হবে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানিটি ১ মার্চ থেকে সেবা দেওয়া শুরু করে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক বাড়াতে কৌশল তৈরি করতে তাহজীব আলম সিদ্দিকী। বিশেষ করে তিনি মানবাধিকার ও জঙ্গি দমন বিষয়ে মার্কিন নীতিনির্ধারকসহ বিডেন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

বিশ্ববাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি ও রেমিটেন্স বাড়েনি। এতে ডলারের বিপরীতে রুপি দুর্বল হয়েছে। এমনকি চলতি বছরের শুরুতে প্রতি ডলার আমদানি ব্যয় ছিল ৮৬ টাকা। এখন ডলার কিনতে হয় গড়ে ১০৬ টাকায়। এত দাম দিয়েও ডলার পাচ্ছেন না আমদানিকারকরা। অনেক ব্যাংকে এলসি খোলার জন্য ডলার নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেও বাজারের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫.২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করেছে। গত অর্থবছরে বিক্রি হয়েছিল ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার।

ডলার বিক্রির ফলে এরই মধ্যে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে। গত বছরের আগস্টে, যেখানে রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে হিসাব করলে বাংলাদেশের মজুদ এখন ২৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভের এই পরিমাণ চার মাসের কম সময়ের আমদানি দায় মেটানোর সমান। এ অবস্থায় আইএমএফ কিছু শর্ত সাপেক্ষে বাংলাদেশকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিচ্ছে।

এ দিকে দেশের সরকার লবিস্ট রাখছে দলের খরচ করে এই বিষয়টির সমালোচনা করেছেন অনেকেই।বিশেষ করে দেশের স্বার্থে লবিস্ট রাখা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, সরকার রাজনৈতিকসহ নানা কারণে লবিস্ট নিয়োগ করে। আগামী নির্বাচনে সরকারের লবিস্ট খরচ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

About Rasel Khalifa

Check Also

দুপক্ষের সংঘর্ষে নিহত ১: পুরুষ শূন্য গ্রাম, আতঙ্কে পালিয়েছেন নারীরাও

মাদারীপুরের শিবচরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে সোমবার দুপুরে হিরু মাতুব্বর নামে একজন নিহত হয়েছেন। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *