‘ঘটনা যে সময় ঘটেছিল সেই সময় আমার ছেলে সেখানে ছিল না। সে নেত্রকোনার বাড়িতে গিয়েছিল। ছাত্রলীগ করাটাই তার বড় অপরাধ।’
গতকাল (মঙ্গলবার) অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর আবু জাফর মোহাম্মদ কামরুজ্জামান যিনি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ১ এর বিচারক তার আদালতে বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ের পর ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি অমিত সাহার মা দেবী সাহা। দেবী রানী এ বিষয়ে আরো বলেন, ‘মিডিয়ার চাপে পড়ে আমার ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাকে এখানে কোনো অপরাধ না করেও ঘটনার সাথে জড়ানো হয়েছে। সে নাকি শুধুমাত্র মেসেঞ্জারেই কথা বলেছিল, তার কারনেই তাকে যাবজ্জীবন! এটা কী ধরনের বিচার, আশা করেছিলাম অমিত মুক্তি পাবে। ‘
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপর আসামি মুয়াজ আবু হুরায়রাও রায় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে। রায় শুনতে তার মা আদালতেই ছিলেন। মুয়াজ বুয়েটের ইইই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র। তার মা একটি গনমাধ্যমকে বলেন, ‘মুয়াজ আবরারকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। টাকা খরচ করে ওষুধ, স্যালাইন কিনেছে। তাকেই যাবজ্জীবন সা’জা দেওয়া হলো।’ রায়ের সময় আ’সামিদের প্রিজন ভ্যান ও এজলাসে আনা-নেওয়ার সময় স্বজনদের অনেকেই তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
সাজাপ্রাপ্ত মোর্শেদ অর্মত্য ইসলামের বাবা মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম। তিনি একটি গনমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে খুঁজে পুলি’শে দিয়েছি। নিজে তাকে আত্মসমর্পন করিয়েছি। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে এই রায় আশা করিনি। গণহারে ফাঁ’সি ও যাবজ্জীবন দেওয়া হলো। এতে আমরা হতবাক। এমন রায়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার আকস্মিকতায় এই হ’/ত্যাকা’ণ্ড ঘটেছে। কেউ পেশাদার অপরাধী না। সবাই মেধাবী শিক্ষার্থী। আমরা উচ্চ আদালতে যাবো।’
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ডেকে নেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। পরে একই দিন রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের দোতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি। এই হত্যার ঘটনায় আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে রাজধানীর চকবাজার থানায় বুয়েট শাখার ছাত্রলীগের ১৯ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হ’ত্যা মামলা দায়ের করেন।
শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে ৭ অক্টোবর সংগঠনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে সাধারণ সম্পাদক রাসেলসহ বুয়েট শাখার ১১ নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। একই অভিযোগে ১৪ অক্টোবর অমিতও ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। ১১ অক্টোবর বুয়েট প্রশাসন ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে। ২১ নভেম্বর হত্যা মামলায় সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে ২৫ শিক্ষার্থীকে বুয়েট থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাদের অধিকাংশই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।
মামলার তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান।
অভিযুক্ত ২৫ জনের মধ্যে এজাহারভুক্ত ১৯ জন ও তদন্তে প্রাপ্ত আরও ৬ জন। এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৭ জন ও এজাহার-বহির্ভূত ৬ জনের মধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানব’ন্দি দেন ৮ জন। এখনও পলাতক ৩ আসামি। পলাত’করা হলেন, মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মুজতবা রাফিদ। এদের মধ্যে প্রথম দু’জন এজাহারভুক্ত এবং শেষের জন এজাহার-বহির্ভূত আসামি।
২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে আবু জাফর মোহাম্মদ কামরুজ্জামান যিনি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক তিনি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। আবরারের ঘটনার মামলায় মোট ৬০ জন সাক্ষীর মধ্য থেকে ৪৭ জন সাক্ষ্য প্রদান করে।
হাইকোর্টে আসামিদের আপিল ও বিচারক অসুস্থ থাকার কারনে মামলার অধিকাংশ কর্মকান্ড এক মাসের মতো স্থগিত করা হয়। দীর্ঘ শুনানির পর ও যুক্তিতর্ক উপাস্থাপন শেষে ৮ ডিসেম্বর এই বিচারের রায় ঘোষণা দেওয়া হলো। বিচারকের রায়ে ২০ আসামির মৃ’ত্যুদ’ণ্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আবরারের বাবা।