মা যে কতো বড় সম্পদ সন্তানের জন্য সেইটা বলে বুঝানো যাবেনা। মায়ের ঋণ কোনোদিনই শোধ করা সম্ভব না। যার মা নেই তার থেকে দুর্ভাগা দ্বিতীয়টি আর কেউ নেই। তাই মা বেঁচে থাকতে তার সেবা যত্ন করে দোয়া নেওয়ার সুযোগ কোনোভাবেই হাত ছাড়া করা ঠিক না। সম্প্রতি জানা গেছে এক ছেলে তার মায়ের বন্যা প্লাবিত স্থানে মায়ের কাছে যেতে রাবারের নৌকায় করলেন দুর্গম যাত্রা।
জরুরী কাজে ঢাকা গিয়েছিলেন রনি। সেখান থেকে তিনি জানতে পারেন সুনামগঞ্জ প্লাবিত হয়েছে। প্রথমে বাবা বললেন বন্যার পানি দ্রুত বাড়ছে। এরপর ৪৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি।
পরে ঢাকা থেকে রাবার বোট ও একটি লাইফ জ্যাকেট কিনে সিলেটের উদ্দেশে রওনা হন রুবেল তালুকদার রনি। জিপিআরএস নেটওয়ার্কের উপর ভরসা করে নৌকাটি স্রোতে ভাসছে। কিন্তু মাঝপথে বিপদে পড়েন তিনি। লিখেছেন ইয়াহিয়া ফজল
তিনি মোবাইল ফোনে বাড়িতে বন্যার পানি বৃদ্ধির বিষয়ে সর্বদা সচেতন ছিলেন। তবে বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) রাতে পরিবারের সঙ্গে শেষ কথা বলেছেন তিনি। এরপর তিনি আর যোগাযোগ করতে পারেননি। এদিকে পুরো সুনামগঞ্জ জেলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সময়ের সাথে সাথে তার পরিবারের জন্য রনির দুশ্চিন্তা আকার ধারণ করতে থাকে। সে বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। খবর পান, নৌকার তীব্র সংকট। ভাড়া চাওয়া হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি। ফলে তিনি ঢাকা থেকে সাত হাজার টাকায় একটি রাবার বোট ও একটি লাইফ জ্যাকেট কিনে শুক্রবার সিলেটে চলে যান। পরের দিন জিপিআরএস দেখে ছাতকের পথ ঠিক করে নৌকায় ওঠেন।
রনির কথায়, ‘আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল শিবের বাজার-রাণীগঞ্জের ভেতর থেকে কারেন্টের সঙ্গে ৬০-৭০ ডিগ্রি কোণে থাকা। এক সময় আমি জিপিআরএস ট্র্যাক করতে পারতাম না। পরে আমি চার-পাঁচটি পরিচিত গ্রাম পেরিয়ে যেতে চাইলাম। তাহলে কাজ হয়ে যেত। ‘
অবশ্য নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়া রনির জন্য নতুন নয়। বললেন, ‘আমি ১৩-১৪ বছর বয়সে কম্পাসের ব্যবহার শিখেছি। ছাতক পেপার মিল থেকে স্কাউট ক্যাম্পিংয়ে গিয়ে। নিয়মিত চার-পাঁচ কিলোমিটার হাঁটি। আমার ট্রাভেল ব্যাগে সব সময় একটা মিনি কম্পাস থাকে। ’
গুগল ম্যাপ দেখে রনি বুঝলেন, সিলেট সদর উপজেলা থেকে জলপথে ছাতকের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। এরপর তিনি সদর উপজেলা থেকে যাত্রা শুরু করেন রাবারের নৌকায়। কম্পাস আর জিপিআরএস ট্র্যাকারের সাহায্যে চার কিলোমিটার পাড়ি দিয়েও ফেলেন এক ঘণ্টায়। এর মধ্যে বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে জিপিআরএস সিস্টেমও কাজ করছিল না। রনির বর্ণনায়, ‘আমার কান্না পাচ্ছিল। কারণ চার কিলোমিটার অতিক্রম করেছিলাম মাত্র এক ঘণ্টায়। বাকি ১১.০৭ কিলোমিটার। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল। ছাতকও যেতে পারিনি। ’
জিপিআরএস সিস্টেম কাজ না করায় রনি বুঝতে পারেন, তিনি প্রকৃত অর্থেই বিপদে পড়ে গেছেন। কী করা উচিত ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছিলেন না। তাঁর ভাগ্য ভালো এ সময় পাশ দিয়ে একটি ত্রাণবাহী নৌকা যাচ্ছিল। তিনি হাত নেড়ে নৌকার লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু নৌকার লোকজন তাঁকে প্রথমে পাত্তা না দিয়ে চলে যাচ্ছিল। রনি তখন মরিয়া হয়ে হাত নাড়াতে শুরু করলে নৌকা তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসে।
সিলেটের সমাজসেবী আব্দুল জব্বার জলিল ত্রাণ নিয়ে বন্যাকবলিত এলাকাগুলো বের করলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মদনমোহন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সমাজ কর্মকার প্রধান আবুল কাশেম। কিভাবে রনিকে উদ্ধার করা হয়েছে এর বর্ণনা, ‘চলতি রাস্তায় খবর জানতে তিনি ভোট দিয়ে এক লোককে দেখান। আমাদের ব্যবসা হাত নাড়ান। শুনতে শুনতে শুনতে শখ জানাচ্ছেন। তাই শুরুতে অবস্থানকে গুরুত্ব দিই। তখন তিনি কিছু চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আমরা জয় ৫০০ হাত হাত, তার উপর নৌকার ইঞ্জিনের শব্দ। কিছু জানাও না। একপর্যায়ে যখন হাত লাফালাফি শুরু, তখন চিন্তা করতে পারি তিনি দুই সমস্যায় সমস্যায়ন। তখন আমরা নৌকায় ঘুরতে গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করি। ‘
নৌকায় ওঠার পর কান্নায় পড়েন রনি। তিনি জানান, মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে মেরিয়া হয়ে এ চেষ্টা করেছিলাম।
আরো তিন-চার ঘণ্টা গেলে রনি মারাও যেতে পারতেন জানিয়ে আব্দুল জব্বার বলেন, ‘পানিতে ডুবে নয়। অঝোর বৃষ্টিতে ঠাণ্ডায় তিনি মারাও যেতে পারতেন। আমরা যখন তাঁকে উদ্ধার করি, তখন তাঁর হাত-পা ও শরীর ঠাণ্ডায় সাদা হয়ে গেছে। তিনি থরথর করে কাঁপছিলেন। এরপর রনিকে সঙ্গে নিয়ে ত্রাণকাজ সেরে উদ্ধারকারীরা নগরের মদিনা মার্কেট এলাকায় তাঁকে নামিয়ে দেন।
গত রবিবার দুপুর দেড়টার দিকে ত্রাণবাহী একটি ট্রাকে করে ছাতকের উদ্দেশে রওনা দেন রনি। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি বাড়ি পৌঁছেন। বাড়ির সবাই সুস্থ আছে দেখে স্বস্তি পেয়েছেন। বললেন, ‘এত কষ্টের পরও মায়ের মুখটা দেখে শান্তি লাগছে। ’
প্রসঙ্গত, মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কোনো শেষ নেই। মা অনেক ব্যাথা শ্য করে সন্তনাকে জন্ম দেন। তারপর থেকে জীবনের আরাম আয়েশ বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে করে তোলেন বড়। মায়ের ভালোবাসা ছাড়া কোনো সন্তানই মানুষের মতো মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারেনা কোনোদিন।