বঙ্গবন্ধু হলো সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী। তার সাথে তুলনা চলেনা কারো। তার মতো আত্মত্যাগ কেউ করেনি। তিনি হলেন বাঙ্গালী জাতির পিতা। তার মতো মহানায়ক বাংলার মাটিতে আর দ্বিতীয়টি আসবে কিনা সন্দেহ আছে। সম্প্রতি জানা গেল বাঙ্গালী জাতির এই মহান পিতার ছবি রাখার জন্য চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল মহিউদ্দিন আহমেদকে।
আমাদের পরম বন্ধু মহিউদ্দিন আহমেদ (মধু) মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বহু মানুষকে শোকের সাগরে ভাসিয়েছিলেন। গাফফার ভাইয়ের মৃত্যুর পরপরই মহিউদ্দিন ভাইয়ের চলে যাওয়ার বেদনা আমাদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধে এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর অবদানের তুলনায় তাঁর মৃত্যুর খবরকে আমাদের মিডিয়ায় তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি দেখে আমার মতো অনেকেই হতাশ। আমরা আশা করেছিলাম, শ্রদ্ধা জানাতে তাকে কিছুক্ষণ শহীদ মিনারে রাখা হবে, কিন্তু তা করা হয়নি। প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন একাত্তরে বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানি দূতাবাসে কর্মরত কূটনীতিকদের একজন যারা যুদ্ধের শুরুতে বাংলাদেশের প্রতি নিঃস্বার্থ আনুগত্য দেখিয়েছিলেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তান দূতাবাসের অডিট প্রধান লুৎফল মতিন। আরও দু-চারজন ছিলেন যাদের মধ্যে সাহাবুদ্দিন আহমেদের নাম স্পষ্ট মনে আছে। সেই সময়ে বিবিসি বাংলা বিভাগে কর্মরত রাজিউল হাসান রঞ্জু (পরে রাষ্ট্রদূত) এবং ফজলে রাব্বি মাহমুদের সাথে মহিউদ্দিন ভাইয়ের বহু বছরের বন্ধুত্ব ছিল, তাই তিনি তাদের সাথে মার্চের আগে বাংলাদেশের আন্দোলন নিয়ে কথা বলতেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত কয়েকজন কূটনীতিকের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা বিদেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে তাদের অনেকেই নিজেদের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পরই তাদের বেতন, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেই বাংলাদেশের পক্ষ নিয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেকেই আবার অপেক্ষা করছিলেন। মরহুম মহিউদ্দিন আহমেদ, লুৎফল মতিন ও সাহাবুদ্দিন সাহেব ছিলেন ব্যতিক্রমী। মহিউদ্দিন ভাই ছিলেন মনে-প্রাণে মুজিব সৈনিক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে অবিচল। ‘৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমাদের আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল পাকিস্তানি দূতাবাসের সামনের ফুটপাত। সেকেন্ড সেক্রেটারি মহিউদ্দিন ভাই দূতাবাসের বেসমেন্টে বসতেন, যেখান থেকে তিনি জানালা দিয়ে আমাদের দেখা মাত্রই গরম কফি পাঠিয়ে দিতেন, যা বরফের শীতে আমাদের উজ্জীবিত করত। মার্চ মাসে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে এসে নির্বাসনে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মহিউদ্দিন ভাই বিচারপতি চৌধুরীকে জানান যে তিনি এখন বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করতে চান। কিন্তু বিচারপতি চৌধুরী তাকে অপেক্ষা করতে বলেন, যাতে মহিউদ্দিন ভাই পাকিস্তান দূতাবাসের গোপন নথি সরবরাহ করতে পারেন, যা মহিউদ্দিন ভাই করেছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার ‘ডেজ অব লিবারেশন ওয়ার ইন এক্সাইল’ বইয়ে লিখেছেন, ‘১০ এপ্রিল বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দিতে গেলে মহিউদ্দিন বলেন, তিনি আমার নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন। গত ১ আগস্ট অ্যাকশন বাংলাদেশ আয়োজিত বৈঠকে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে পাকিস্তান দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমেদ ফোনে বলেছিলেন যে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখাতে প্রস্তুত। এখানে পাকিস্তান সরকারে কর্মরত কূটনীতিকদের মধ্যে মহিউদ্দিন আহমেদ সমগ্র ইউরোপে প্রথম পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ‘ (পৃ. 6)।
আমরা মার্চের শুরু থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লবিং শুরু করি, যখন মহিউদ্দিন ভাইয়ের দেওয়া গোপন তথ্য কাজে আসে, যে তথ্যগুলো আমরা ছাপিয়েছিলাম ব্রিটিশ এমপিদের দেওয়ার জন্য। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ, আফরোজ চৌধুরী এবং আমি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দোরগোড়ায় তিনদিনের অনশনে যাওয়ার পর, মহিউদ্দিন ভাই আমাদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে গভীর রাতে অনশন করেন। সেখানে উপস্থিত তৎকালীন ছাত্রনেতা (বর্তমানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ প্রধান) সুলতান শরীফ মহিউদ্দিন ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এদিকে আসুন, ভয় পাবেন না?’ ১৯৭১ সালের ১লা আগস্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারে এক সমাবেশে বাংলাদেশের পক্ষে তিনি এ ঘোষণা দেন। তবে গত কয়েক মাসে তিনি বাংলাদেশের জন্য গোপনে কী করেছেন তা খুব কম মানুষই জানেন। তিনি বাড়িভাড়া বা ভাতার কোনো দাবি করেননি, যা অনেকেই করেছেন। এ সময় তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের বলহাম এলাকার ৩৬ বেলামি স্ট্রিটে আরেক প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা জাকিউদ্দিনের বাড়িতে মাত্র একটি কক্ষ বিশিষ্ট একটি বাড়িতে বসবাস করছিলেন। ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর লন্ডন সফরের সময় তিনি বিশেষ দায়িত্বে ছিলেন এবং সার্বক্ষণিক বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন। এর আগে ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন খোলার ক্ষেত্রে তাকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল। মহিউদ্দিন ভাই এবং লন্ডনে আমাদের তৎকালীন মিশন প্রধান ফারুক আহমেদ চৌধুরী ব্রিটিশ সংগঠন অ্যাকশন বাংলাদেশ-এর সেক্রেটারি মেরিটা প্রোকপের স্মরণে ট্রাফালগার স্কোয়ারের একটি গির্জায় একটি স্মরণসভার নেতৃত্ব দেন। মহিউদ্দিন ভাই এবং ফারুক ভাই আমাকে এবং রুনি সুলতানাকে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় দুটি গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে আমরা দুটি রবীন্দ্রসংগীত গাইলাম। মহিউদ্দিন ভাই, ভারতীয় দূতাবাসের সহযোগিতায়, ইন্দিরা গান্ধী, যিনি নভেম্বরে লন্ডন সফরে এসে বাংলাদেশি ও ভারতীয়দের উদ্দেশে যে বিশাল কর্মসূচীতে ছিলেন, তাতেও বিশেষ ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতার পর কিছু স্বাভাবিক পদোন্নতির পর তিনি বাংলাদেশে জাতিসংঘ মিশনে ডেপুটি চিফ অব মিশন নিযুক্ত হন। তখন ক্ষমতায় ছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। এ সময় জাতিসংঘ সফররত কয়েকজন বিএনপির সংসদ সদস্য নিউইয়র্কে মহিউদ্দিন ভাইয়ের কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার অফিসে এই ছবি কেন?’ ওই সংসদ সদস্যরা দেশে ফিরে খালেদা জিয়াকে বিষয়টি জানালে খালেদা মহিউদ্দিন তার ভাইকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান। এরপর জীবিকার সন্ধানে একটি বীমা কোম্পানিতে চাকরি নেন। এভাবে বছর দুয়েক পর প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তার পক্ষে রায় দেয়। তার মামলায় সহায়তা করেন ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হক। যেহেতু আমি তখন আইন পেশায় ব্যারিস্টার হিসেবে নিযুক্ত ছিলাম, সেক্ষেত্রে মহিউদ্দিন ভাইয়ের জন্য কিছু করার সুযোগও ছিল আমার। অবসর গ্রহণের পর কোনো বিশেষ সুবিধা ছাড়াই তিনি সংবাদপত্রে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। তার বেশিরভাগ লেখাই ছিল ব্রিটেনের মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে। তিনি কঠোরভাবে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, রবীন্দ্রসংগীতের অনুরাগী ছিলেন, নীতির প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। খালেদা জিয়ার আমলে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ছিলেন এবং সচিব ছিলেন কুখ্যাত রাজাকার হামিদুল হক চৌধুরীর জামাতা রিয়াজ রহমান। একদিন রাজাকার জামাতা সচিব মহিউদ্দিন ভাইয়ের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে ব্যঙ্গ করলে মহিউদ্দিন ভাই খোলাখুলি জবাব দেন যে তার উচিত। কয়েক বছর আগে লিভারের সিরোসিস ধরা পড়লে প্রধানমন্ত্রী তার চিকিৎসার খরচ দিতে সিঙ্গাপুরে যেতে রাজি হন। তিনি সিঙ্গাপুরে গেলেও চিকিৎসকরা তাকে আশা দিতে না পারায় বিনা চিকিৎসায় ফিরে আসেন। এরপর বেশ কয়েক বছর তিনি সুস্থ ছিলেন। কয়েকদিন আগে আমার ছোট মেয়ে ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরীর শ্বশুর মহসিন ভাইকে দেখতে গিয়েছিলাম, যিনি বঙ্গবন্ধুর কট্টর সমর্থক ছিলেন। এটাই ছিল তার সঙ্গে শেষ দেখা। পুরোটা সময় তিনি একাত্তরের লন্ডনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।
অসাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য মহিউদ্দিন ভাইয়ের চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। ‘৭১ সালে লন্ডনে তার সঙ্গে যারা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন, আমিসহ অনেকেই এখন ঢাকায় আছেন, যেমন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, লুৎফল মতিন, সাবেক রাষ্ট্রদূত রাজিউল হাসান রঞ্জু, ডক্টর জোয়ার্দ্দার, ডক্টর কামরুজ্জামান, বিচারপতি আবু সাঈদ। চৌধুরীর ছেলে আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার, আবদুল মজিদ চৌধুরী মঞ্জু, ব্যারিস্টার রাবিয়া ভূঁইয়া ও খন্দকার মোশাররফ হোসেন ড.
তার আগে জাকারিয়া চৌধুরী, সুরাইয়া খানম, স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান আজিজুল হক ভূঁইয়া, স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও ব্যারিস্টার শফিউদ্দিন বুলবুলসহ আরও অনেকে মারা গেছেন। যারা বেঁচে আছেন এবং মহিউদ্দিন ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। ২১শে জুন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাডেমিতে অনুষ্ঠিত জানাজায় তাদের অনেকেই অংশ নেন। তিনি আর ফিরবেন না, কিন্তু তার স্মৃতি কখনো ম্লান হবে না।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো.
প্রসঙ্গত, মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অন্যতম একজন রাজনীতিবীদ। এছাড়াও তিনি দেশের হয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের একজন গর্বিত নাগরিক। তারমতো এমন একজন বিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ ব্যক্তিকে বাংলার মানুষ সারাজীবন সম্মানের সহিত স্বরণ করবে।