বাংলাদেশ ও ভারতের সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি নানা দিক থেকে উত্তেজনাপূর্ণ। ভারতের ভেতরকার সংকট এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন বেশ স্পষ্ট। মনিপুর এবং পাঞ্জাবের স্বাধীনতাকামী আন্দোলন, চীনের লাদাখ ও অরুণাচলে দখল, নেপালের নতুন মানচিত্রে ভারতীয় ভূমি অন্তর্ভুক্তি, এবং আফগানিস্তান থেকে ভারতের পরাজয়প্রসূত কূটনৈতিক ব্যর্থতা—সবই ভারতের সাম্প্রতিক দুর্বলতা চিহ্নিত করে।
বাংলাদেশের দিক থেকে বিষয়টি আরও স্পষ্ট। ৭০ শতাংশ ভারতীয় এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। অথচ ভারত, বাংলাদেশের ওপর ক্রমাগত ষড়যন্ত্র এবং হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকারকে ব্যবহার করে ভারতের স্বার্থরক্ষার প্রচেষ্টা এখন ধাক্কা খেয়েছে। হাসিনার ক্ষমতা হারানোর পর বাংলাদেশের জনগণের ঐক্য ও স্বাবলম্বিতা ভারতীয় পরিকল্পনার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, যেখানে তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী পাঠানোর প্রস্তাব দেন, এরপর থেকে বাংলাদেশের জনগণের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। মমতার এই মন্তব্যকে অনেকেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং অযৌক্তিক হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ভারতের এমন আচরণ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করেছে।
তারপরও কর্তৃত্ববাদী ভারতের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। দেশটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে লাগাতার প্রচারণা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতির চাকা গতিশীল করে তুলেছে। তারপরও কূটনৈতিক রীতিনীতি ভেঙে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করছে।
স্বাধীন সার্বভৌমত্বে বাংলাদেশ স্থিতিশীল ও শক্তিশালী। হাসিনাকে হটানোর মধ্য দিয়ে দেশের ১৮ কোটি মানুষ এখন ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ। অন্যদিকে ভারতই কার্যত অস্থিতিশীল, সার্বভৌমত্বে ভঙ্গুর ও হুমকির মধ্যে রয়েছে। কখন দেশের ভেতরের স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহ করে এবং প্রতিবেশীদের শত্রুরাষ্ট্র হওয়ায় কখন ভূমি দখল করে নেয় বলা মুশকিল। মনিপুরের স্বাধীনতাকামীরা তো পাঁচ বছর আগে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বিদেশে প্রবাসী সরকার পর্যন্ত গঠন করেছে।
হাসিনা পালানোর পর ভারতের হুমকি-ধমকি এবং সীমান্তে অবরোধ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান বলেছেন, ভারতের নেতাদের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি এবং বাংলাদেশের বিশেষ অঞ্চল দখলের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য ফাঁপা বেলুনের মতোই। ওদের (ভারত) বাংলাদেশ নিয়ে কোনো অপকর্ম করার চেষ্টা আত্মঘাতীর নামান্তর।
বাংলাদেশের সেনা-বিজিবির ১০০ সদস্য ভারতের এক হাজার সেনাকে পরাভূত করার সামর্থ্য রাখে। ভারত কখনো আত্মঘাতী কিছু করার চেষ্টা করলে সীমান্তেই ওদের পুঁতে রাখার সামর্থ্য আছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের অংশ বিশেষ দখল দূরের কথা, ভারতই খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাবে।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তিনি বাংলাদেশ উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি বাংলাদেশের পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতিসংঘের শান্তিসেনা পাঠানোর প্রস্তাব করেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার অধিবেশনে। বাংলাদেশে শান্তিসেনা পাঠানোর জন্য ভারত সরকারকে জাতিসংঘের সঙ্গে কথা বলার আর্জি জানান তিনি।
মমতার এই বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ। বিজেপি বিরোধী হাওয়ায় মমতা বাংলাদেশের অনেকেরই ‘গুডবুকে’ ছিলেন। এমন বক্তব্যকে কেউ বলছেন ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের নিয়ে ভারতের মোদির কাছে এমন আর্জি জানানো উচিত হয়নি।
মমতার উচিত ছিল বাংলাদেশের বদলে কাশ্মিরি, মনিপুরি, পাঞ্জাবিদের খালিস্তান আন্দোলন বিষয়ে জাতিসংঘে আলোচনার আর্জি জানানো। অবশ্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, উনি এই বক্তব্য কেন দিলেন এটি আমি বুঝতে পারছি না। রাজনীতিবিদরা তো সবসময় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। আমি মনে করি এটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির জন্য সহায়ক হবে না।
সিলেটের সুতারকান্দি স্থলবন্দরের ওপারে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ এলাকায় বাংলাদেশ অভিমুখে মার্চ করেছে হিন্দু ঐক্যমঞ্চের কয়েকশ’ নেতাকর্মী। এক পর্যায়ে তারা বাংলাদেশে প্রবেশেরও চেষ্টা চালায়। এ সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও করিমগঞ্জ পুলিশের সদস্যরা কাঁটাতারের ব্যারিকেড দিয়ে তাদের বাধা দেয়। কলকাতা ও আসামে বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন অফিসে হামলা করেছে বিজেপির নেতাকর্মীরা।
এ ছাড়া হাসিনা পালানোর পর থেকে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ইস্যু সীমিত করা নিয়ে চলছে বিতর্ক। অবশ্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই দিল্লিকে পাশ পাটিয়ে অন্য দেশ থেকে ইউরোপের দেশগুলোর ভিসা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের ভ্রমণকারীরা ভারতের বদলে অন্য দেশে ভ্রমণ করছে। অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশের ভিসা ইস্যু বন্ধ করায় কলকাতার হোটেল ব্যবসায়ী ও হাসপাতালগুলোর মালিকরা জানিয়েছেন, তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। মূলত ভারতের এসব বাড়াবাড়ি দিল্লির নাচের পুতুল মাদার অব মাফিয়া শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক পুনর্বাসনের চেষ্টা।
ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে পক্ষে অবস্থান নেয়ায় দিল্লির লোকসভার অধিবেশনে নরেন্দ্র মোদিকে মুসলিম নেতা আসাদউদ্দিন ওআইসি তুলোধুণো করেছেন। আসাদউদ্দিন ওআইসি বলেছেন, ‘মোদিজি হাসিনাকে ছাড়েন, বাংলাদেশের জনগণকে ধরেন। হাসিনাকে দিল্লিতে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাতুকুতু খেলা বন্ধ করেন।’ আবশ্য ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। তখন বাংলাদেশ অল্প সময়ের জন্য অসুবিধায় পড়লেও বাংলাদেশ এখন গরুর গোশতে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।
প্রবাদে রয়েছে ‘আত্মীয় পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু প্রতিবেশী পরিবর্তন করা যায় না’। এ জন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা অপরিহার্য। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী ভারত এমন একটি দেশ যে দেশের সঙ্গে কোনো প্রতিবেশীর সুসম্পর্ক নেই। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শত্রুতা দীর্ঘদিনের। কয়েক দফায় তারা যুদ্ধ করেছে। আফগানিস্তান, নেপালের সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ। শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও নেই সুসম্পর্ক। আওয়ামী লীগ রেজিমে হাসিনাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া প্রচার করা হলেও দিল্লি কার্যত ঢাকাকে তাদের তাঁবেদারে পরিণত করেছিল। ভারতের সহায়তায় শেখ হাসিনা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পাতানো নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঢাকার চেয়ে দিল্লির স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হতো।
এ সুযোগে সিভিল প্রশাসন, মিলিটারি প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে ভারতের পছন্দ মতো কর্মকর্তাদের প্রমোশন দেয়া ও গুরুত্বপূর্ণ পদে ভারতীয় তাঁবেদারদের বসানো হয়। সে সময় আকাশ সংস্কৃতির নামে কিছু সুশীল, বুদ্ধিজীবী, আমলা, শিক্ষককে টাকার বিনিময়ে দিল্লির তাঁবেদার হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ওই তাঁবেদাররা সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে ভারতের সেভেন সিস্টার্সের স্বাধীনতাকামীদের কোণঠাসা করে রাখে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যের স্বাধীনতাকামীদের বাংলাদেশ ‘ঠেকিয়ে রাখায়’ ভারতের সামরিক খরচ কিছুটা কমে যায় এবং বেঁচে যাওয়া অর্থ থেকে কিছু উচ্ছিষ্ট বাংলাদেশের দিল্লির তাঁবেদার দালালদের দেয়া হয়। ওই সময় ভারতের তাঁবেদারি এবং বেশি বেশি তোষামোদি করতেই দিল্লির হাইকমিশন ছাড়াও কলকাতা, চেন্নাই, ত্রিপুরাসহ কয়েকটি রাজ্যে বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন অফিস খোলা হয়। সেগুলোর মধ্যে কলকাতা ও আগরতলা উপ-হাইকমিশন অফিস ভাঙচুর করা হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে দিল্লিতে হাইকমিশন থাকার পরও ভারতের বিভিন্ন এলাকায় উপ-হাইকমিশন অফিসের কতটুকু প্রয়োজন? ভারত গণহত্যাকারী হাসিনাকে খাইয়ে-দাইয়ে একদিকে হৃষ্টপুষ্ট করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ভারতের বেশির ভাগ গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে প্রতিদিন ‘ফেইক’ নিউজ প্রচার করছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমগুলো ধারাবাহিকভাবে ফেইক নিউজ প্রচার করায় বাংলাদেশের সব মত-পথের রাজনৈতিক দল, সামজিক সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ ভারতের অপপ্রচার সম্পর্কে সতর্ক হয়েছে এবং ভারতের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে গেছে। এমনকি ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে ফেইক নিউজ প্রচার করায় ভারতের অনেক নাগরিক প্রতিবাদ করছেন, তারা সে দেশের কিছু গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ তুলছেন।
অফ্রিকার গরিব দেশগুলোর মতোই হিন্দুত্ববাদী ভারত সংখ্যালঘু নির্যাতনের আতুড়ঘর। সে দেশে মুসলমান নাগরিকদের উপর নানা জুলুম-নির্যাতন করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। হিন্দুত্ববাদী ভারতের ‘ভারতমাতা কি জয়’ সেøাগান দেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদ আর নেতাকর্মীদের মুখে নিয়মিতই শোনা যায়। যারা এ সেøাগান দিতে রাজি হন না তাদের ওপর অত্যাচার করা হয়। সংখ্যালঘু মুসলমানের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়। গরুর গোশত খাওয়ার অভিযোগে সংখ্যালঘুদের প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
কয়েক দিন আগেও উত্তর প্রদেশের উপ-নির্বাচনে পাঁচজন মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যে ভারত সংখ্যালঘু নির্যাতন রাষ্ট্রীয়ভাবে করতে অভ্যস্ত তারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কাল্পনিক অভিযোগ তুলেছে। হিন্দু উগ্রবাদী সংগঠন ইসকনের সাবেক নেতা ও বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে শিশুদের সাথে বলাৎকার ও নারীদের সঙ্গে অবৈধ যৌনকাজে লিপ্ত থাকার অপরাধে ইসকন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সেই চিন্ময়কে রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারত? রাষ্ট্র হিসেবে ভারত কি শিশু ধর্ষককে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়!
প্রবাদে রয়েছেÑ ‘খালি কলসি বাজে বেশি’। ভারত কার্যত ওই খালি কলসের মতোই। অক্ষম দেশ অথচ হাঁকডাক ও তর্জন-গর্জন করছে। বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনতা জেগে উঠলে হিন্দুত্ববাদী ভারত এমনিতেই চুপসে যাবে।