সরকার দীর্ঘ দিন ধরে বিনা ভোটে ক্ষমতা দখল করে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে। কিন্তু মুখে বলছে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য তারা লড়াই করছে।শুধু তাই নয় তাদের মন্ত্রী-এমপিরা দেশের উন্নয়নের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। অথচ বাস্তবে ভিন্নচিত্র প্রকাশ পাচ্ছে।সরকার উন্নয়নের নামে মেগা প্রকল্পগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের সুযোগ করে দিয়েছে নেতাকর্মীদের। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন ডাঃ আব্দুন নূর তুষার হুবহু পাঠকদের জন্য নিচে দেওয়া হলো।
স্ট্যাটিসটিক্স শব্দটির উৎপত্তি স্টেট সংক্রান্ত ম্যাথম্যাটিক্স থেকে। দ্বাদশ শতকে বৃটিশরা নিজেদের টিকে থাকা ও যুদ্ধ করার ব্যয় বহনের জন্য যথেষ্ট সম্পদ আছে কিনা এটা হিসাব করা চেষ্টা করে। তখন পৃথিবীতে টেকনোলজি কম। প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূমি – কিছু মূল্যবান ধাতু এসবই সম্পদ। ইনট্যাঞ্জিবল বা অদৃশ্য সম্পদের বিষয়টা তখনো নাই।
আরব সহ বিভিন্ন স্থানে গোত্রগুলো উট ভেড়া খেজুরগাছ নারী সহ সম্পদ গুনতো। এই হিসাব তার চেয়ে একটু বেশি উন্নত ছিলো। আরবে প্রাসাদ ছিলো না বেশি। ইউরোপে রাজা গজাদের কিছু প্রাসাদ ছিলো।
আধুনিক সময়ে জিডিপি বা একটি জাতির মোট সম্পদের হিসাব করার বিষয়টি বেশি পুরোনো না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই হিসাব কাঠামোটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে এতে নানা পরিবর্তন আসে ও একটি জাতির সম্পদের হিসাব ও প্রবৃদ্ধি বুঝতে এটার ব্যবহার শুরু হয়। উন্নয়ন এর হিসাব নিয়ে শুরু হয় পূঁজিবাদ ও সাম্যবাদের ঠান্ডা লড়াই। এই লড়াইতে পাশ্চাত্য ঋণ নির্ভর পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত সফলতা পেতে থাকে। মার্শাল প্ল্যানের টাকায় ইউরোপকে পূণর্গঠন করতে আমেরিকা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালে। জার্মানি বৃটেন জাপান কোরিয়া সিঙ্গাপুর। ঋণ নাও। উন্নতি করো। এই খেলায় জিডিপি ঋণ রেশিও বা অনুপাত হিসাব করে যতো জিডিপি ততো ঋণ এই সূত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ইটালি একবার রাতারাতি হিসাবের পদ্ধতির মধ্যে পরিবর্তন এনে এক রাতে বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ অর্থনীতি হয়ে গিয়েছিলো। এটাই জিডিপির ম্যাজিক।হিসাবের খেলা।
এক হিসাব দুবার করেও জিডিপি বাড়ায়। ইপিজেড থেকে পলিথিন প্যাকে শার্ট বের হলেই রপ্তানি। যে পলিথিন বাইরে থেকে শার্ট প্যাক করতে ইপিজেডে ঢুকলো সেটাও রপ্তানি। এক পলিথিন দুবার রপ্তানি হলো।রাশিয়ানরা কম্যুনিস্টদের আমলে এভাবে বহুদিন প্রবৃদ্ধি ও জাতীয় আয় আর সম্পদ মেপেছে।কম্যুনিজম ঠেকাও। ভোগ বাড়াও। ঋণ নাও। উন্নয়ন করো। এই পলিসিতে ঋণ হলো মৃতসঞ্জীবনি সুরা।
সমস্যা হলো পরিসংখ্যানের উন্নতি সবসময় আসল উন্নতি না। দিনশেষে মানুষ খায় ডাল ভাত আলুভর্তা। যে সেতু বা অট্টালিকা সে বানায় তাতে তার গাড়ী চলে না – সে সেখানে থাকে না।
অদৃশ্য সম্পদকে সম্পদ বানিয়ে জিডিপি ফাঁপে। মাইক্রোসফট এর সম্পদ কিছু চেয়ার টেবিল অফিসস্পেস আর সার্ভার কম্পিউটার ও যন্ত্রপাতি। সে যা বানায় তার কোনো দৃশ্যমান আকার নাই। সফ্টওয়্যার তো বায়বীয়। এর মূল্য নতুন ভার্সন বের হলে আগেরটা জিরো। অথচ সফটওয়্যার সম্পদ।
কারণ এখানে ম্যান আওয়ার আছে। উচ্চশিক্ষার খরচ আছে। সমস্যা হলো এটাই যে কে ঠিক করলো মাথা খাটানোর ঘন্টাপ্রতি দাম বেশি আর শরীর খাটানোর ঘন্টাপ্রতি দাম কম?
কে ঠিক করে ওয়েস্টার্ন গার্মেন্টসের পাপিয়ার এক মাসের আয় বারো হাজার আর ওয়েস্টিন সুইমিংপুলের পাপিয়ার এক ঘন্টার দাম লাখের হিসাবে? এই সব প্রশ্ন পূঁজিবাদে অচল।
যে কয়লা আপনি তুলতে পারবেন না সেটাকে সম্পদ ধরে আপনার জিডিপি বাড়ায়। ঋণ দেয়। তারপর সেই কয়লা সে তোলে-বেচে-ব্যবহার করে। আপনি তার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তাকে সেই পয়সা দিয়েই কয়লা তুলিয়ে তার কাছে কয়লা বেচে তাকেই সুদসহ ঋণ পরিশোধ করেন। দিনশেষে আপনি কয়লার কালি মেখে জিডিপি পেয়ে খুশি।
এই কোম্পানিগুলোর মূল্য হয় আকাশচুম্বি কারণ এতে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে। তাই এর অদৃশ্য ভ্যালুয়েশন বাড়ে। বেচলে এটা কেনার ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি এমনকি বহু রাষ্ট্রেরও নাই। এইসব মূল্যকে হিসাব করলে জিডিপি বাড়ে। কিন্তু এই মূল্যের বা বিনিয়োগের প্রায় কিছুই জনতার কাছে পৌঁছায় না। এই মূল্যের ধারণাও স্পেকুলেটিভ। পারসেপশন নির্ভর।
বিল বা বেজোস বড়লোক হলে আমেরিকা ধনী হয়। শ্রমিকের ভাগ্য খুব একটা বদলায় না।
তাই নিউইয়র্কের স্কাইস্ক্র্যাপার বানাতে জার্সী থেকে শ্রমিক আসে। যতো স্কাই স্ক্র্যাপার ততো মূল্যস্ফীতি। একসময় সে দেখে তার বানানো নিউইয়র্কে সে থাকার ক্ষমতা রাখে না। রেল শ্রমিকরা রেলরোড বানানো শেষ হলে কুলি হয়ে রেল স্টেশনে কাজ করে।
সম্পদ বাড়ে কিন্তু শ্রমিক গরীব হয়। সেটা সে বোঝে না। যতোক্ষন সে ডালভাত পায় ততোক্ষন সে টিকে থাকে পরদিনের ডালভাত আয় করার জন্য।
জিডিপি বাড়ে। আরো ঋণ আসে। আরো অট্টালিকা আর সেতু হয়। আরো দাম বাড়ে। আর সে টিকে থাকার সংগ্রাম করতে করতে শেষ হয়ে যায়। সে ধনীদের উন্নয়ন দেখে কিন্তু তার নাগাল পায় না।
দিনশেষে জিডিপি না। সাধারণ মানুষ ডাল ভাত ডিম আলুভর্তা খাবে। এই ডিম ডাল আলু দিতে না পারলে – জিডিপি হলো ঘোড়ার ডিমের পাতুরি।না আছে ঘোড়া। না ঘোড়ার ডিম। না আছে পাতা। তার আবার পাতুরি।
তাই লিপস্টিক আর স্যান্ডেলের উন্নতি হলে উন্নতি হয়েছে মনে করে যারা তারা ভুলে যায় বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। বাংলার মানুষ মুক্তি চায়। বাংলার মানুষ অধিকার চায়। এই কথা বলার মানুষটি দেশের মানুষ খেতে না পেলে নিজে দুবেলা কি করে খাবেন বলে কষ্ট পেতেন।নিজের ঘরের পাহারাদার পুলিশকে হাত ধরে খেতে নিয়ে যেতেন।
কারণ তিনি জানতেন এই সাধারণ মানুষ দুবেলা দু মুঠো ভাত পেলে খুশি। আলুভর্তা ডাল পেলে খুশি।
আজ কি লজ্জাহীন স্পর্ধায় লিপস্টিক দেখে দুঃখ কষ্ট বোঝার অভিনব উন্নয়ন সূচক আবিস্কার করেছেন তারা। স্যান্ডাল সম্পদ দেখে জিডিপি বাড়ানোর চেষ্টা তাদের।
জিডিপিতে নির্লজ্জতার পরিমাপ করে সম্পদ হিসাবে যোগ করলে নিশ্চিতরূপে আমরা এখন পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় জিডিপির দেশ হবো।রবীন্দ্রনাথ। বঙ্গবন্ধু আমাদের মানুষ হতে দেখে আপনার কথা বক্তৃতায় বলেছিলেন। এখন আমাদের আবার অমানুষ হতে দেখার পালা।