দেশে লঞ্চে আগুন লেগে একসাথে এতো মানুষ নিহ’ত হওয়ার ঘটনা এই প্রথম, যেটা সত্যিকারভাবে অনাকঙ্খিত একটি ঘটনা। ঝালকাঠি সদর উপজেলার সুগন্ধা নদীতে লঞ্চের ইঞ্জিন রুমে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪২ যাত্রী নিহ’তের খবর পাওয়া গেছে। দমকল কর্মীরা সেখানে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে ২৯টি দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করেছে এবং অন্য ছয়টি নদীতে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে। এরপর বাকিরা চিকিৎসাধীন এবং অন্য সময় প্রয়াত হন। ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক জোরার আলী ঘটনার বিষয়ে উদ্ধার স্থলে পরিদর্শনের পর বলেন, “এই ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি তদন্ত করে প্রকৃত কারন বের করা হবে।” ভোর ৩টার দিকে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুনের সূত্রপাত হয়।
প্রায় ৪০০ যাত্রী নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে এমভি অভিযান -১০ সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। চাঁদপুর ও বরিশাল টার্মিনালে লঞ্চটি থামে এবং যাত্রী ওঠানামা করেন। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পৌঁছলে রাত ৩টার দিকে এতে আগুন ধরে যায়।
স্মরণকালের ভ’য়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে ৪১ জন প্রয়াত হয়েছেন। এছাড়া ৮০ জনেরও বেশি যাত্রী দগ্ধ হয়েছেন। দুর্ঘটনার সময় অনেক যাত্রী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে গেলেও এখনো নিখোঁজ রয়েছেন শতাধিক। লঞ্চে কেন আগুন লাগল এ নিয়ে নানা কৌতুহল রয়েছে অনেকের মনে।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, সুগন্ধা নদীতে আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চের ইঞ্জিন রুমে রাসায়নিক পদার্থ ছিল, যার বড় অংশ ছিল কেরোসিন। এ ছাড়া দাহ্যপদার্থ লুব্রিকেট ও হাইড্রোলিক অয়েল ছিল। পাশের স্টোর রুমেও ছিল বিপুল পরিমাণ তেল। এসব পদার্থ লঞ্চের ইঞ্জিন রুমে থাকলে যেমন নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকতে হয়, তা ওই লঞ্চে ছিল না।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক বলেন, ইঞ্জিন রুমের তেলের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন ধরলে ড্রাম গরম হয়ে ভেতর থেকে তেল বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। মুখ বন্ধ থাকায় বেরিয়ে আসতে না পারায় কয়েশ টন শক্তি উৎপাদন করে ড্রামগুলো বি’স্ফোরিত হয়। বি’স্ফোরিত হলে আগুনের তীব্রতা আরও বাড়ে। এর পর পাশের ড্রামগুলোও বি’স্ফোরিত হতে থাকে। বি’স্ফোরণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কেরোসিন তেলে আগুন লাগলে প্রচুর কালো ধোঁয়া উৎপন্ন হয়। ইঞ্জিন রুম পানির মধ্যে হওয়ায় ধোঁয়া পাইপসহ বিভিন্ন ফাঁকা দিয়ে ওপরে চলে যায়। ধোঁয়ায় জন্য দম বন্ধ হয়ে মানুষ প্রয়াত হন।
এই অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেন, বি’স্ফোরণের মাধ্যমে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় লোকজন নিজেদের বাঁচানোর সময় অনেক কম পেয়েছে। এছাড়া গভীর রাতে লোকজন ঘুমিয়ে ছিল। ফলে প্রাণহানি বেশি হয়েছে।
প্রাণহানির জন্য অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক এই পরিচালক। তিনি বলেন, অগ্নিনিরাপত্তা পদ্ধতি, আগুন শনাক্তের যন্ত্র ও সতর্কীকরণ পদ্ধতি দুর্বলতা ছিল। ফলে লোকজন যেখানে ছিল, সেখানেই দগ্ধ হয়ে ও ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে মা’রা গেছে। এ ছাড়া ইঞ্জিন রুমে তেল রাখতে হলে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে সেটা আলাদা করতে হয়। সেটা না করায় দুর্ঘটনার পর মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বেড়েছে।
এদিকে, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী যিনি নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন তিনি সার্বিক পরিস্থিতি তদারকি করতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান, এমনটি জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম খান। ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অতিরিক্ত পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন বিভাগ) সাইফুল ইসলাম এর নেতৃত্বে থাকবেন বলে বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে। এদিকে ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাজমুল আলমের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে, এমনটি জানিয়েছেন ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক জোহর আলী।