আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঋণের শর্ত বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে বিশেষ ছাড় দিচ্ছে। এর মধ্যে তারা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের পরিমাণ কমাচ্ছে, ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে পুরোপুরি বাজারে ছেড়ে দিতে তাদের আরও সময় দিচ্ছে। এ ছাড়া ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করা, রাজস্ব বৃদ্ধি, কর অব্যাহতি কমিয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে। এ বিষয়ে ঢাকা সফররত আইএমএফ মিশন বৃহস্পতিবার সকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে শেষ বৈঠক করবে। এরপর বিকেলে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কোন খাতে কী ধরনের ছাড় দেওয়া হবে তা চূড়ান্ত করবেন।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফ বাংলাদেশের পক্ষে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ওই মাসের শুরুতে বাংলাদেশকে ঋণের প্রথম কিস্তির জন্য ৪৭০ মিলিয়ন ডলার মওকুফ করে। ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আগামী নভেম্বরে বিতরণ করার কথা রয়েছে। এ লক্ষ্যে বর্তমানে আইএমএফের একটি মিশন বাংলাদেশ সফর করছে। তারা ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করছে। গত ৪ অক্টোবর থেকে মিশনটি কাজ শুরু করে। আজ বৃহস্পতিবার শেষ হবে। তারা ওয়াশিংটনে ফিরে আসবে এবং কাউন্সিলের কাছে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন পেশ করবে। বোর্ড এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
আগের ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন না করায় আইএমএফ শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় ধাপের ঋণের অর্থ পরিশোধ স্থগিত করেছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার ব্যালেন্স শিটে ভারসাম্য আনতে বাংলাদেশ ঋণ নিচ্ছে। এটি বর্তমানে স্বল্প সরবরাহে রয়েছে। আইএমএফ এ খাতের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ঋণ দেয়। এছাড়া নবগঠিত আইএমএফ জলবায়ু তহবিল থেকে ঋণ গ্রহণকারী এই অঞ্চলে বাংলাদেশই প্রথম। ফলে বাংলাদেশের ঋণ স্থগিত হলে আইএমএফ তহবিলের ঋণে অন্যান্য দেশের সুদ কমে যাবে।
সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফের বৈঠকে যোগ দেবেন গভর্নর। ওই বৈঠকে রিজার্ভ, বিনিময় হার ও সুদের হারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। এরপর অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অন্যান্য বিষয় চূড়ান্ত করা হবে। এ নিয়ে বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা একাধিক বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে, তারা রিজার্ভ কম রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কখন বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে, কখন রিজার্ভের নেট অ্যাকাউন্ট সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হবে। এর আলোকে বৈঠকে আইএমএফকে জানানো হবে।
সূত্র জানায়, ঋণ বিতরণের সময় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু শর্ত আরোপ করেছে আইএমএফ। গত জুলাইয়ের মধ্যে ১৪টি শর্ত বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু মাত্র ২টি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ১২টি আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে।
আইএমএফ মিশন জুন থেকে জুলাইয়ের মধ্যে যে শর্তগুলি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল এবং ডিসেম্বরের মধ্যে সেগুলি বাস্তবায়নের জন্য নেওয়া পদক্ষেপগুলির অগ্রগতি পর্যালোচনা করেছে। এটি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী শর্তের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও পর্যবেক্ষণ করছে।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের ১৭টি মৌলিক শর্ত বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে ১১টি জুনের মধ্যে, ৩টি জুলাই এবং বাকি ৩টি ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। আরও ৫টি শর্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ জুলাই মাসে শুরু হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে ১০০% বাস্তবায়ন করতে হবে।
শর্ত অনুযায়ী, গত জুনের মধ্যে জিডিপি আকারের ১০.৫ শতাংশ রাজস্ব বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে এ পদক্ষেপ নিয়েছে। এটি ১০০% বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গত জুনের মধ্যেই ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ নবায়নসহ মোট খেলাপি ঋণের চিত্র বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে প্রকাশ করার একটি শর্ত ছিল। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এটি প্রকাশ করা সম্ভব না হলেও গত আগস্টের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা প্রকাশ করেছে।
আইএমএফের এই বছরের মিশনের বড় আপত্তি হল রিজার্ভের নেট অ্যাকাউন্ট এখনও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছায়নি। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার সম্পূর্ণ বাজার ভিত্তিক হতে হবে। এটাও করা গেল না। এ বিষয়ে আরও সময় দেবে আইএমএফ।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বাজারভিত্তিক জ্বালানি তেলের দামও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তারাও এ বিষয়ে জোর দিয়েছেন।
আইএমএফ বলেছিল, গত জুনের মধ্যে দেশের মোট রিজার্ভ থাকতে হবে ২ হাজার ৯৯৬ মিলিয়ন ডলার এবং নেট রিজার্ভ থাকতে হবে ২ হাজার ৪৪৬ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু ওই পর্যায়ে রিজার্ভ বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে, গ্রস ২৬৮৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে এবং নেট রিজার্ভ ২১০৭ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে গ্রস রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী জুনের মধ্যে তা বাড়িয়ে ৩ হাজার ৪২০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। সেজন্য সংরক্ষণের শর্ত শিথিল করার প্রস্তাব করা হয়েছে।