Thursday , November 21 2024
Breaking News
Home / Politics / যৌন অবদমনের শিকার সমাজের অসুখ বেরিয়ে আসে জঘন্য কায়দায়: রাহাত

যৌন অবদমনের শিকার সমাজের অসুখ বেরিয়ে আসে জঘন্য কায়দায়: রাহাত

তিশা-মুশতাক বিষয়ে আপাতত এটাই শেষ পোস্ট। এটি লিখতে হচ্ছে কারণ আমার আগের পোস্টে দেড় হাজারের উপর কমেন্টস পড়েছে। সব কমেন্ট পড়ার মত ধৈর্য, সময় বা রুচি না থাকলেও কমেন্টসের প্যাটার্ণ বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ঘুরেফিরে কয়েকটি বিষয় পাঠকরা তুলে ধরতে চাইছেন। পাঠকদের মধ্যে যেমন কুৎসিত গালিবাজ আছেন, তেমনি শিক্ষিত লোকজনও আছেন।
একটা কমন প্রশ্ন ছিল, আমার ১৮ বছর বয়সী মেয়ে/বোন যদি জনাব মুশতাকের মত ৬২ বছরের ‘বৃদ্ধকে’ বিয়ে করতে ইচ্ছুক হয়, আমি কি মেনে নেবো, আমি কি বাধা দেবো না?
এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, আমি বাধা দেবো না। অবশ্যই মেনে নেবো। শারীরিক,মানসিক ও আইনগতভাবে পরিণত বয়সের একজন মানুষ যে কি না নিজের ভাল-মন্দ বুঝতে পারার সক্ষমতা অর্জন করেছে, তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আইন কাউকে দেয় না। পরিণত বয়সের পর পিতা-মাতারও ক্ষমতা নেই বাধা দেওয়ার। কাছের ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমরা তাকে বড়জোর ভাল পরামর্শ দিতে পারি, এরবেশি কিছু করার এখতিয়ার আমাদের নেই। (বাই দ্যা ওয়ে, আমার কোনও সন্তান নেই)
এবার তিশা-মুশতাকের শো-অফের বিষয়টা নিয়ে কিছু বলা যাক। বিষোদগার করা হচ্ছে এটা বলে যে, ওরা প্রতিদিন ওদের বিয়ের বিষয়টা সোশ্যাল মিডিয়ায় শো-অফ করবে কেনো?
করবে, অবশ্যই শো-অফ করবে। আমরা কি চাই সমাজের ভয়ে ওরা একঘরে হয়ে থাকুক? এক্ষেত্রে হয় ওদেরকে চুপ করে থাকতে হবে, নইলে শো-অফই করতে হবে। এছাড়া ভিন্ন কোনও পথ ওদের জন্য খোলা নেই। ওদের সম্পর্কটাকে পরিবার মেনে নেয়নি। সমাজ ওদেরকে হাসি-ঠাট্টার আইটেম বানিয়ে রেখেছে। তাহলে ওরা যাবেটা কোথায়? সোশ্যাল মিডিয়ায় ওরা যা করছে তা আসলে সোশ্যাল রিকগনিশান (সামাজিক স্বীকৃতি) পাবার আকুলতা থেকে করছে। সেকারণে বারবার বারবার ওরা ওদের বিয়ে,পরিবারের মেনে না নেওয়া, সুখে থাকার কেচ্ছা-কাহিনী নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। এটাকে শো-অফ না বলে রেজিলেন্স ‘বিদ্রোহ‘ বলা সঙ্গত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম না থাকলে ওদের এই শো-অফ বা রেজিলেন্স পাবলিক ডিবেটের কারণ হতো না।
অনেকেই ওদের এই ঘটনাটিকে জনাব নবী মুহাম্মদ ও মিসেস আয়েশার কাহিনীর সাথে মিলিয়ে উপস্থাপন করছেন। এই উপস্থাপনটা ভুল। প্রথম কথা হচ্ছে, তিশা-মুশতাক দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে দেশের প্রচলিত আইন মেনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু জনাব মুহাম্মদ ৫৬ বছর বয়সে যাকে বিবাহ করেন, সেই আয়েশা ছিলেন ৬ বছরের শিশু। ওই বয়সের একজন শিশুর পক্ষে বিয়ের মত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্মতি দেওয়া সম্ভব ছিল না। সুতরাং এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, জনাব মুহাম্মদ ও জনাবা আয়েশার বিয়ে পাত্র-পাত্রীর যৌথ ও স্বাধীন সম্মতি ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছিল। যদিও আইন-কানুনের বালাই না থাকা ওই বর্বর সময়ে এই জাতীয় বাল্যবিবাহ অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। তাই মুশতাক-তিশার বিবাহকে নবী মুহাম্মদ-আয়েশার বিয়ের সাথে মিলিয়ে উপস্থাপন করা যাবে না।
হুমায়ুন-শাওনের ঘটনার সাথে তিশা-মুশতাকের ঘটনার তুলনা কেনো?
হুমায়ুন-শাওনের বিয়ের বিষয়টা আনা হয়েছে এটা দেখাতে যে তিশা-মুশতাকই কেবল এরকম বিশাল এইজ গ্যাপ নিয়ে বিয়ে করেননি। তাছাড়া হুমায়ূন-শাওনকে বইমেলা থেকে তিশা-মুশতাকের মত অপমানিত হয়ে বেরিয়ে যেতে হয়নি। এইখানে দুটি ভিন্ন সময়ের দুইজোড়া দম্পত্তির লেখক সত্ত্বা ও ইন্টেলেকচুয়ালিটির তুলনা করা হয়নি। আমার বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদ দুর্দান্ত প্রতিভাধর কিন্তু প্রচুর আজেবাজে বইয়ের লেখক ছিলেন। যার মিসির আলী, গল্প সমগ্র, ও কয়েকটা উপন্যাসকে আমি মাস্টারপিস মনে করি। পক্ষান্তরে, মুশতাক-তিশা’র বই আমার পড়া হবে কী না সন্দেহ আছে। বইয়ের নাম ও প্রচ্ছদ দেখে বইয়ের ভেতরে তাকানোর আগ্রহ আমার হবে না এ ব্যাপারে আমি প্রায় নিশ্চিত।
একটা কথা শোনা যাচ্ছে যে মুশতাক স্কুলের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ছিলেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্কুলের মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করতেন। তিশাকেও তিনি নাকি সেভাবে ফুঁসলিয়ে পটিয়েছেন।
বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিসে সিনিয়র-জুনিয়র পজিশনের প্রেম, বিয়েকে নিরুৎসাহিত করা হয়। স্কুলের স্যার বা ম্যাডাম ছাত্রী/ছাত্রের প্রেমে পড়লে কিংবা অফিসের বস সরাসরি জুনিয়র কর্মীদের কারও সাথে প্রকাশ্য সম্পর্ক করলে বা বিয়ে করলে সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়। স্যারের প্রেমিকা আমার সহপাঠি হলে অথবা বসের বউ আমার সমান পজিশনের কলিগ হয়ে গেলে পরীক্ষায় গুড গ্রেড নিয়ে আমার সন্দেহ দেখা দিতে পারে বা প্রমোশন নিয়েও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া লাগতে পারে। এইসব বিবেচনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে এই জাতীয় সম্পর্ককে নিরুৎসাহিত বা নিষিদ্ধ করা হয়। মুশতাক সাহেব এই জাতীয় কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন কি না আমার জানা নেই। এইসব ক্ষেত্রে থার্ড গ্রেডের নিউজ পোর্টালের রিপোর্টে নির্ভর করাটা ঠিক মনে করি না। আমাদের বুঝা দরকার, একটা নিউজ পোর্টাল বা দৈনিক পত্রিকা একটা কিছু লিখে দিলেই সেটাকে সাথে সাথে সত্য বলে ধরে নেওয়া যাবে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন পোর্টালে লেখা হয়েছে জয়া আহসান ধর্ষণের শিকার এবং আপনিই সেই ধর্ষক। পুরো নিউজ পড়ে দেখা গেলো জয়া একটা সিনেমায় অভিনয় করছেন যেখানে একটা রেইপ সিন আছে এবং ওই রেইপিস্টের ভূমিকায় যে অভিনয় করছেন তার নাম আর আপনার নাম একই। আইন-আদালতে প্রমাণিত হওয়ার আগে কাউকে অপরাধী বানানো ঠিক নয়।
তিশা-মুশতাকের এই জাতীয় শো-অফ, আদেখলাপনার ফলে কি উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের উপর প্রভাব পড়বে না?
প্রভাব পড়বে। তবে তিশা-মুশতাক এই জাতীয় শো-অফ না করলেও প্রভাব পড়বে। গুগল, টিকটক, ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, চ্যাট জিপিটির এই জামানায় আপনি কার মুখ, কয়জনের মুখ বন্ধ করবেন? পারবেন না, এটা অসম্ভব ব্যাপার। সুগার ড্যাডি, সুগার মম, জেন জি ইত্যাদি শব্দগুলো সম্পর্কে জেনেছি বেশিদিন হয়নি। ওদিকে বইমেলায় মিজান পাবলিশার্সের সামনে দাঁড়িয়ে স্কুলের মেয়েগুলো তিশা-মুশতাককে নিয়ে হাসি-মশকরা করার করার সময় যেভাবে সুগার-ড্যাডি সুগার-ড্যাডি বলে বলে গলা ফাটাচ্ছিল, তাতে বুঝতে বাকি নেই এরকম বহু টার্ম ওরা ইতিমধ্যে ভেজে খেয়ে বসে আছে। এমন না ওই মেয়েগুলো ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ুয়া। সুতরাং তিশা-মুশতাককে দমন করে লাভ হবে না। একমাত্র সঠিক পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পারে ছেলেমেয়েদেরকে লোভী হওয়ার কবল থেকে বাঁচাতে। ‘জনাব মুশতাকের প্রচুর টাকা আছে, গাড়ি-বাড়ি আছে, তাই সে বয়স্ক হলেও অসুবিধা নেই, তার মত কাউকে যেকোনও উপায়ে কব্জা করতে হবে। টাকাই সব সুখে এনে দেবে।‘ এই জাতীয় চেতনা ভয়াবহ! বয়স্ক মানুষকে ভালবাসা বা বিয়ে করা দোষের কিছু নয়, কিন্তু তাকে বিয়ে করে নিজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণি অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর চিন্তা কুৎসিত হতে পারে। এই চিন্তার পেছনে নিজের নির্লজ্জ আত্মসমর্পনের ইচ্ছে থাকতে পারে। বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, স্কিলে নিজেকে তৈরি ও শাণিত না করে পরগাছার মত সুগার ড্যাডি/সুগার মমের পয়সায় সুইজারল্যাণ্ড-নরওয়ে-ক্যানাডা ঘুরে বেড়ানোর শখ চূড়ান্ত রকমের অশ্লীল ব্যাপার। এই ধরণের চিন্তাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করার কোনও কারণ নেই। সেকারণেই আমি মনে করি পাঠ্যপুস্তকে প্রেম, বিয়ে, সম্পর্ক, যৌনতা, সুগার ড্যাডি-সুগার মম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এক্সপার্টদের দিয়ে খোলামেলা আলাপ করার ব্যবস্থা করতে হবে। তা নাহলে, এই বৈষম্যযুক্ত, নৈতিক অবক্ষয়ের ভোগবাদী সমাজে সীমাহীন লোভের হাতছানি থেকে ছেলেমেয়েদেরকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
শেষে বলতে চাই, যৌন অবদমনের শিকার সমাজের অসুখ বেরিয়ে আসে জঘন্য কায়দায়। এরা যেকোনোও সম্পর্ককে দেখতে থাকে নিজেদের অবদমিত হওয়ার হতাশা থেকে। পারিবারিক অশিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক কুশিক্ষা ও ধর্মকেন্দ্রিক অনুশাসনের চাপ এদের দৃষ্টিভঙ্গীকে এমন শেইপ দেয় যে মানুষের প্রতি মানুষের ন্যূনতম সম্মান ও মর্যাদা এরা দেখাতে পারে না। দুজনের মধ্যে বিশাল বয়সের গ্যাপ থাকলেও একটা দম্পত্তিকে প্রকাশ্যে ‘ভুয়া ভুয়া’ বলা বা তাদের বয়স নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা বা তাদেরকে বইমেলা থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করা একটা অন্যায়, অশোভন, অশ্লীল ও অপরাধমূলক কাজ এটা এরা অনুধাবন করতে পারে না। তারচেয়ে হতাশার বিষয় হচ্ছে, এই অপরাধী মবকে সমর্থন করে সো-কল্ড শিক্ষিত নারী-পুরুষকে বড়ো বড়ো পোস্ট লিখতে দেখা যাচ্ছে।
তিশা-মুশতাক আমাদের সমাজে সফট টার্গেট। এদেরকে সহজেই শিকার করা যায়। এদেরকে ‘ভুয়া ভুয়া’ দুয়োধ্বনি দেওয়া যায়। পারলে রাষ্ট্রের দুর্নীতিবাজ এমপি, মন্ত্রী, ভূমিদস্যু, দালাল, চোর-বাটপারদের বিরুদ্ধে ভুয়া-ভুয়া বলেন। ওইটা আসলে দরকার। আপনার-আমার আলটিমেট হতাশার, দুরবস্থার কারণ এই মাফিয়ারা, তিশা-মুশতাকরা নয়।

About Zahid Hasan

Check Also

‘আ.লীগ রঙ দেখছে, কিন্তু রঙের ডিব্বা দেখেনি’ দল যে সিদ্ধান্ত নেবে মাথা পেতে নেব

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান বলেছেন, বিএনপি যদি ব্যক্তিগতভাবে স্থানীয় নির্বাচনে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়, তাতে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *