দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্রমেই কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আগের বছরের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে। তবে সবচেয়ে বেশি কমেছে গত আগস্টে। বিদায়ী মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৯ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরে ২০৪ কোটি বিলিয়ন এসেছিল। সে অনুযায়ী এক মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে সাড়ে ২১ শতাংশ। শুধু তাই নয়, জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টও কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
রেমিট্যান্স প্রবাহ অস্বাভাবিক কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল নয়া দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, রেমিটেন্স কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ মানি লন্ডারিং। এই অর্থ পাচার বন্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও সংকটে পড়তে হবে। তিনি বলেন, দেশে যখন ডলারের সংকট চলছে, তখন বৈদেশিক মুদ্রা বেশি হারে আসা উচিত ছিল। কিন্তু ঘটছে উল্টোটা। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির পরিবর্তে কমছে। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। আর এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রার দায় মেটানো কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, ডলার সংকট বাড়লে টাকার মান কমবে। আর টাকার মান কমলে একই পরিমাণ পণ্য আমদানিতে বেশি অর্থ ব্যয় হবে। মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তিনি বলেন, এ জন্য নীতিনির্ধারকদের আগে ঠিক করতে হবে কী করতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে নিরাপত্তার অভাব হলে দেশে বিনিয়োগ করতে মানুষ ভয় পায়। কষ্টার্জিত অর্থের নিরাপত্তার জন্য বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে। এটি প্রতিরোধে নীতিগত পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে আমরা বড় ধরনের সংকট এড়াতে পারব না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত ছয় মাসে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে বিদায়ী মাসে অর্থাৎ আগস্টে। উদাহরণস্বরূপ, গত মার্চ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২.০২ বিলিয়ন। এপ্রিলে এটি ১.৬৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। মে মাসে প্রায় ১.৬৯ বিলিয়ন আগের মাসের মতোই ছিল। জুন ছিল ২.২০ বিলিয়ন ডলার। এরপর আবার কমতে থাকে। জুলাই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১.৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর গত আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১.৬ বিলিয়ন ডলারে। তবে পয়েন্ট টু পয়েন্ট অর্থাৎ রেমিট্যান্স প্রবাহ গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে ৬ শতাংশ কমেছে, যেখানে আগস্টে তা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১.৫ শতাংশ কমেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি মাসেই দেশ থেকে বিদেশ কর্মী যাওয়ার হার বাড়ছে। এর বিপরীতে বেশি হারে রেমিট্যান্স আসার কথা থাকলেও ঘটছে উল্টো। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে বৈধ মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসছে না। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। আর সে কারণেই খোলা বাজারে বেড়েছে ডলারের দাম। খোলা বাজারে প্রতি ডলারের বিপরীতে এ খাতে খরচ হচ্ছে ১১৮ টাকা পর্যন্ত। যেখানে প্রতি ডলার আন্তঃব্যাংক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও আমদানিকারকরা বলছেন, কোনো ব্যাংকে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। হুন্ডির কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কম আসছে। এ কারণে গত সপ্তাহে ৭টি মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আরও ১০ জন মানি চেঞ্জারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
এ দিকে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং হাউসকে (এসিইউ) এ সপ্তাহে ১.২ বিলিয়ন ডলার দিতে হবে। আর এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাবে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত ছিল নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারের ওপরে থাকতে হবে। ব্যাংকাররা বলেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হুন্ডির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নীতিগত সহায়তায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে না পারলে সামনের ভয়াবহ বিপদ এড়ানো সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা করছেন তারা।