প্রায় এক দশক আগের কথা, ২০১৫ সালের ৭ জুন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম বাংলাদেশ সফরের সময় ঘটে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা ভারতের আদানি গ্রুপের সাথে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে। সফরের শেষে একটি যৌথ বিবৃতি জারি করা হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘নতুন প্রজন্ম – নঈ দিশা’। ওই বিবৃতিতে ছিল নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার মধ্যে ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদটি ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল বিদ্যুৎ খাতে ভারত-বাংলাদেশের সহযোগিতার কথা।
অর্থাৎ, এই ঘোষণা দ্বারা দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সরবরাহে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ‘২০২১ লক্ষ্য’ বাস্তবায়নে ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান মোদী। তবে, সরাসরি ভারতীয় কোনো কর্পোরেট সংস্থার নাম উল্লেখ না করা হলেও, আদানি পাওয়ার এবং রিলায়েন্স পাওয়ারের প্রতিনিধিরা ছিলেন সফরসঙ্গী, এবং এই সফর থেকেই আদানি পাওয়ারের বাংলাদেশের বিদ্যুৎ রফতানি চুক্তির পথ সুগম হয়।
গৌতম আদানির নেতৃত্বাধীন আদানি গ্রুপের প্রস্তাব ছিল একেবারেই নতুন, যেখানে তারা ভারতীয় মাটিতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশের কাছে রফতানি করবে। অন্যদিকে, রিলায়েন্স পাওয়ার বাংলাদেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এবং এলএনজি টার্মিনাল তৈরির প্রস্তাব দেয়। যদিও রিলায়েন্সের প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু আদানি পাওয়ারের প্রকল্প ২০২৩ সালে বাস্তবায়িত হতে শুরু করে।
তবে, আদানি পাওয়ার ও বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) এর মধ্যে স্বাক্ষরিত পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট (পিপিএ) নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই চুক্তি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ভারতের বিদ্যুৎ সরবরাহের পথ খোলা হয়। বিশেষ করে, ঝাড়খন্ডের গোড্ডা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে এই বিদ্যুৎ রফতানির বিষয়টি অনেকের জন্য অবাক করার মতো। এই চুক্তি এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু ২০১৫ সালের মোদির ঢাকা সফরেই এর ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল।
এই সফরেই আদানির সঙ্গে সরকারের একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর ব্যবসা পরিচালনা করার পথ সুগম করার বিষয়ে কথা বলা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ভারতের ব্যবসা প্রসারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, যা আদানি গ্রুপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
পরবর্তীতে, ২০২২ সালে গৌতম আদানি শেখ হাসিনার সঙ্গে একাধিক উচ্চপদস্থ বৈঠক করেন, যেখানে তিনি বাংলাদেশের জন্য একাধিক প্রকল্পের সমর্থন প্রদান করেন। ২০১৬ সালের ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পলিসি সামিট’ এও তিনি ঢাকায় এসেছিলেন।
এদিকে, ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগেই গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আদানি প্রতিশ্রুতি দেয়। যদিও নির্ধারিত সময়সীমা মেনে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়নি, পরবর্তীতে ২০২৪ সালের এপ্রিলে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। এই প্রক্রিয়া, প্রাথমিকভাবে, দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যে অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
নরেন্দ্র মোদি ও গৌতম আদানির সম্পর্ক বহু বছর ধরে ঘনিষ্ঠ ছিল। ২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তারা একে অপরের কাছাকাছি আসেন, বিশেষত যখন আদানি গোষ্ঠী গুজরাটে বড় প্রকল্প শুরু করেছিল। পরবর্তীতে মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও তাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়, যার ফলে ভারতের অনেক আন্তর্জাতিক সফরের সময় আদানির উপস্থিতি প্রায় নিশ্চিত ছিল।
এছাড়া, আদানি গোষ্ঠী ও মোদির সরকারকে নিয়ে ভারতের বিরোধী দলের নেতারা নানা অভিযোগ তুলেছেন, বিশেষ করে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে আদানি গ্রুপের আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। তবে আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক কার্যক্রম এবং মোদি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক সত্ত্বেও এ চুক্তি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এভাবে, আদানির সাথে বাংলাদেশের বিতর্কিত চুক্তি, যা মোদির ঢাকা সফরের সময় থেকেই শুরু, তা এখনো আলোচনার বিষয় হয়ে আছে, এবং ভবিষ্যতে এর প্রভাব কেমন হবে, সেটি সময়ই বলবে।