যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলে আসছে। এ লক্ষ্যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত শুক্রবার দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এটা শুধু নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে না, নির্বাচনের ভাগ্যও নির্ধারণ করবে। সরকার এটা উপলব্ধি করলে দেশের কল্যাণ হবে। কারণ বাংলাদেশ সরকারের কোর্টে বল ঠেলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন আমাদের যা করার তা করতে হবে। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, সরকার যেকোনো মূল্যে নির্বাচন আয়োজন করতে চাইলে ভিসা নীতি খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। অন্যদিকে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে যদি আমরা আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক লেনদেন, বিভিন্ন সংস্থার অনুদানের দিকে নজর দেই, তাহলে অবশ্যই এর প্রভাব পড়বে।
প্রশ্ন হলো নির্বাচনকে সরকার কিভাবে দেখছে? নির্বাচনের পর দেশকে চলতেই হবে। আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়া, আর্থিক সহায়তা, বাণিজ্য, দ্রব্যমূল্য, মূল্যস্ফীতি সবই এর সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব বিষয় মাথায় রাখলে সরকার নমনীয় হতে পারে। তবে সরকার ক্ষমতায় থাকাকেই প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তারা মনে করেন, নির্বাচন পরবর্তী ভবিষ্যৎ দেখা যাবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক মো. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভিসা নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনের বদলে আমাদের আচরণে প্রভাব ফেললে আমরা বেশি লাভবান হব। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এটি চালু করেছে। আমরা যদি এটি উপলব্ধি করতে পারি তবে এটি আমাদের কল্যাণ বয়ে আনবে। এটা বিব্রতকর যে বাইরের লোক এসে আমাদের বলতে হচ্ছে যে, আমরা আত্মঘাতী পথে চলছি। এটা তারা ভিসা নীতি কার্যকরের মাধ্যমে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের ইস্যুতে বিদেশিরা বল আমাদের কোর্টে ছেড়ে দিয়েছে। এখন আমাদের যা করার তা করতে হবে। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে ভোটাধিকার, মানবাধিকার অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, সার্বজনীন বিষয়।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশের মতো স্বাধীন ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভিসার বিধিনিষেধ আরোপ মোটেও ভালো নয়। ইতিমধ্যেই আমেরিকার ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশে কিছু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য এবং বিরোধী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে এটি করা হচ্ছে বা হবে। তিনি বলেন, এটা শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব ফেলবে। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনেক সংস্কার প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করতে চাই তারা (সরকার) ভালো নির্বাচন দেবে। আসন্ন নির্বাচন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো হবে না।
ন্যাশনাল ইলেকশন মনিটরিং কাউন্সিলের (জেনিপপ) চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত বিশ্বের পথিকৃত। তাদের দায়িত্বের অংশ হিসেবে তারা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য কাজ করছে। যার অংশ হিসাবে তারা ১০ ডিসেম্বর র্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২৪ মে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে একটি ভিসা নীতি টুইট করেন।
অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ আরও বলেন, আমি মনে করি এবার ত্রিমুখী নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই। যুক্তরাষ্ট্র তার নীতি অনুযায়ী এগোবে। আমাদের সঙ্গে কথা-বার্তা বললে আর ছবি তুললে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা ভুলে যাওয়ার জাতি নয়। কারণ তারা জন্মলগ্ন থেকেই ডেমোক্রেসির কথা বলে যাচ্ছে। আমি মনে করি এটাকে কেবল বায়বীয় বিষয় আর যা করার করুক বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।
সাবেক সচিব ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ আবু আলম। শহীদ খান বলেন, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার। তা হলো- অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। আমরা ভিসা নীতিমালার পর ভেবেছিলাম, নির্বাচনের পর হয়তো তা কার্যকর হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে অতীতের নির্বাচনী রেকর্ডের ভিত্তিতে তারা ব্যবস্থায় যাচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য ভালো নয়, জাতি হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে। কোনো মন্ত্রী, আইনজীবী, বিচারক, প্রশাসক বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ যদি এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েন, তাহলে তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। তাহলে গোটা বিশ্ব জানবে ৫২ বছর আগে যে দেশ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে স্বাধীনতা পেয়েছিল সে দেশে এখন গণতন্ত্র নেই। ভিসা নিষেধাজ্ঞা কারো কারো জন্য আনন্দ বয়ে আনতে পারে। এবং কেউ কেউ বিরক্ত হতে পারে। কিন্তু নির্বাচনের পর যদি আমাদের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হয় তাহলে এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ভিসা নিষেধাজ্ঞার ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার আশ”ঙ্কা রয়েছে। কারণ সরকারি দলের নির্বাচনী প্রচারণা অবাস্তব। বিশেষ করে গত দুই নির্বাচনে তারা যে প্রচারণা চালাচ্ছেন তা বাস্তবতা বিবর্জিত। এমন পরিবেশে সুষ্ঠু নির্বাচন কতদূর সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আমি মনে করি সরকার বিদেশিদের চাপকে চাপ হিসেবে নিচ্ছে না। নিলেও তা প্রকাশ করতে চাচ্ছে না- তৃণমূলের মনোবল নষ্ট হবে ভেবে। আমাদের দেশে ব্যক্তি ও দল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখানে দেশের স্বার্থের কথা ভাবেন না সংশ্লিষ্টরা। তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতার অংশ হয়ে গেছি। এ বিবেচনায় সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই। কিন্তু সরকার তা মনে করে না। আমাদের দেশে যারা সরকারে আছেন তারা নিজেরা নির্বাচন করতে চান। তবে এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার কিছু ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি। না রাখলে দেশে রাজনৈতিক সং”ঘাত ও রক্তপাতের সৃষ্টি হবে।