Thursday , December 26 2024
Breaking News
Home / National / যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে থাকবে বাংলাদেশ : কুগেলম্যান

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে থাকবে বাংলাদেশ : কুগেলম্যান

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারপরও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায় দেশটি। ওয়াশিংটন ভিত্তিক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক ভবিষ্যতে কেমন হতে পারে সে বিষয়ে  কথা বলেছেন।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন, অর্থাৎ ৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’ বলে জানায়। পররাষ্ট্র দপ্তর এই বিবৃতির মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেয় যে বাংলাদেশ নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতিগত অবস্থান বড় ধরনের হোঁচটই খেল। নীতিগত ব্যর্থতার কারণ কী?

মাইকেল কুগেলম্যান: অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র কেন তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, সেটা দুই দেশের পটভূমি থেকেই দেখা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পটভূমি থেকে দেখতে চাইলে লক্ষ করবেন, ওয়াশিংটন অনেকবারই বিভিন্ন দেশে নীতিগত অবস্থানের প্রতিফলন ঘটাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল।

এসব ক্ষেত্রে ব্যর্থতার অনেক দৃষ্টান্তও যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। কাজেই যে কেউ চাইলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ব্যর্থতাকে আরেকটি দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখাতেই পারেন।

আর বাংলাদেশের পটভূমি থেকে দেখলে?
মাইকেল কুগেলম্যান: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিষয়ে তাঁর অস্বস্তি খোলামেলাভাবে প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত নানা ভূমিকা নিয়ে তিনি তাঁর অস্বস্তির কথা জানিয়েছেন।
আবার এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার বিষয়ে মরিয়া ছিল।

রাজনীতির মাঠে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হলে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে, কোনো সহিংসতা না হলে, ভোট কারচুপি না হলে বিএনপির ক্ষমতায় ফেরার পথ সুগম হতো।

বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠত বলে প্রচার করা হয়েছিল। এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দল যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারের চাপ উপেক্ষা করেই নির্বাচন করতে মরিয়া ছিল। বাস্তবে সেটাই ঘটেছে।

মার্কিন চাপ সত্ত্বেও বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে। টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক ভবিষ্যতে কেমন হতে পারে?
মাইকেল কুগেলম্যান: আমার ব্যক্তিগত মতে, মার্কিন সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকবে। ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নিরিখে বাংলাদেশের অবস্থান বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র কোনো ঝুঁকি নেবে না।
বাংলাদেশের গুরুত্বের পেছনে অন্যতম কারণ এই অঞ্চলকে ঘিরে বড় শক্তির প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা, ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বেড়েছে এবং অতীতের মতো বাংলাদেশেও রাশিয়ার শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে।

তাই যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু করবে না যা বাংলাদেশকে চীন বা রাশিয়া বা উভয়ের কাছাকাছি হতে বাধ্য করবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের পরিধি বাড়ছে। বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ। বিস্তৃত পরিসরে আমরা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করছি।

যুক্তরাষ্ট্র চায় না বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগের সুফল শুধু চীনই ভোগ করুক। তাই কৌশলগত ও বাণিজ্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার দিকে মনোনিবেশ করবে।

সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষের মতপার্থক্যের নিরিখে এ বিষয়কে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মাইকেল কুগেলম্যান: বাংলাদেশ সঙ্গে সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সেটা বেশ স্পষ্ট। এতে বলা হয়েছে, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রে গুরুত্ব অব্যাহত থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকবে বাংলাদেশ। একই সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের কৌশলগত দিককেও বিবেচনায় নেবে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ মোকাবিলাসহ নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব থাকবে।

বেশ কয়েক বছর ধরে কৌশলগত দিক থেকে মূল্যবোধের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ট্রাম্পের আমলেও বাংলাদেশের গুরুত্বের প্রসঙ্গটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র দপ্তরের দলিলে এসেছে। বিশেষ করে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল–সম্পর্কিত দলিলে বাংলাদেশের উল্লেখ আছে। সন্ত্রাসবাদ, দস্যুতা দমনসহ নানা বিষয়ের কথা এতে বলা হয়েছে।

আমি মনে করি, ভবিষ্যতে মূল্যবোধ ও স্বার্থের বিষয়গুলো পাশাপাশি রেখে সম্পর্ক এগিয়ে চলবে। ভবিষ্যতে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্বার্থের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাবে।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা বলা হচ্ছে। তথ্য সুরক্ষা আইন (DPA) এর মতো বিষয়গুলিকে ভবিষ্যতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কীভাবে দেখা হবে?
মাইকেল কুগেলম্যান: যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল্যবোধ ও স্বার্থের ভারসাম্য রাখতে চায়, কিন্তু কাজটি সহজ নয়। এর একটি কারণ বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মার্কিন ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিশেষ করে প্রভাবশালী মহলের মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর আগ্রহ রয়েছে। এসব আগ্রহী ব্যবসায়ীদের অনেকেরই প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে চায়। কিন্তু একটি নিপীড়ক পরিবেশ ইন্টারনেটে স্বাধীনতার অনুশীলনের জন্য অনুকূল নয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) বাস্তবায়ন, ফেসবুকে সরকারের সমালোচনার কারণে গ্রেপ্তার ও হেফাজতে মৃত্যুর মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাও ঘটেছে। যেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রযুক্তি খাত থেকে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করছে, ইন্টারনেট অনুশীলনের চিত্রটি স্বস্তিদায়ক নয়।

শুধু বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়া নয়, অনেক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা ও অংশীদারিত্ব রয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিষয়ে ভারত যে একই পৃষ্ঠায় ছিল না, তা গোপন নয়। কেননা ভারতের পাশে ছিল না যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে পদস্খলন?
মাইকেল কুগেলম্যান: বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত অবস্থানের সঙ্গে একমত হয়নি ভারত। বাংলাদেশের অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, ভারত শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিই নয়, বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিকেও প্রভাবিত করেছে।
ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তাহলে ওয়াশিংটন কেন এতদিন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কথা বলে চলেছে?

আমরা এটাও দেখেছি যে, গত দুই-তিন মাসে বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ততটা সোচ্চার হয়নি যতটা আগে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থানের পেছনে ভারতের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত সেপ্টেম্বরে একটি নতুন ভিসা নীতির অধীনে বিধিনিষেধের ঘোষণা ছাড়া নির্বাচনের অগ্রগতিতে নতুন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ভারত যদি মনে করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার উদ্বেগগুলিকে বিবেচনায় নিচ্ছে, তবে এটি দুই দেশের সম্পর্কের জন্য সহায়ক হবে।

তবে আমি মনে করি, নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তেজনাপূর্ণ ও অস্থিতিশীল ছিল। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন নিয়ে শক্ত অবস্থান থেকে সরে আসাই শ্রেয় মনে করেছে।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতিগত অবস্থান একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কি এখনো বাংলাদেশকে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে বিবেচনা করবে? বিশেষ করে যদি ওয়াশিংটনে ক্ষমতা পরিবর্তন করে ডেমোক্র্যাটদের পরিবর্তে রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় ফিরে আসে, তাহলে কি এভাবে চলতে থাকবে?
মাইকেল কুগেলম্যান: মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের তালিকায় মানবাধিকার ও গণতন্ত্র উচ্চ থাকবে। কয়েকদিন আগে মার্কিন সরকারি কর্মকর্তাদের টেলিগ্রামে বিষয়টি উঠে আসে।
অনেক দেশে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জোরালোভাবে প্রচার করে না। আবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়টি তার প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রগুলোর বিবেচনায় নিয়ে আসে।

চীন, রাশিয়া ও মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বারবার কথা বললেও সেসব দেশে কোনো পরিবর্তন নেই। কারণ সেসব দেশে একনায়কতন্ত্র আছে।

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। কেউ কেউ বলতে পারেন যে বাংলাদেশ একনায়কতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য রয়েছে। এ কারণে টেস্ট কেস হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে একধরনের কৌতূহল রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।

রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় এলে মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির ওপর কম জোর দেওয়া হবে। কিন্তু আমরা এটাও দেখেছি যে ট্রাম্পের আমলেও মার্কিন কর্মকর্তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

এ ক্ষেত্রে ঢাকায় সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িতে হামলার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তাই যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলের পর বাংলাদেশের ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

About Zahid Hasan

Check Also

মারা যায়নি আবু সাঈদ, আছেন ফ্রান্সে রনির এমন মন্তব্যে নিয়ে যা জানা গেল

সম্প্রতি টিকটকে পটুয়াখালী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনির একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *