সংক্ষেপে অনেকটা ছোট আকারে খবরটি প্রকাশ হয়েছে। তেমন কোনো ধরনের সাড়াও পড়েনি, কোন ধরনের তেমন আলোচনা হয়নি। ঘটনাটা মুহূর্তেই ভুলে গেল সবাই। কিন্তু যাদের আপনজন চলে গেছে, তাদের সেই ক্ষতি, তারা কি আদৌ ভোলে বা ভুলতে পারে? এটা নিয়ে কেউ কখনও কী ভেবে দেখেছেন।
বলছিলাম ফারজানার কথা। যে গত বুধবার, ১১ জানুয়ারী, মধ্য দুপুরে ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার পর প্রয়াত হয়েছে। প্রেমের সম্পর্ক নয়, পারিবারিক জটিলতা নয় বা চাকরি থেকে বরখাস্ত নয়, নিছক ভয়ে সে একটি উচ্চ ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে। সেটা পুলিশের ভয়ে।
ফারজানার বাড়ি খুলনার বটিয়াঘাটা এলাকায়। মাত্র ১৯ বছর বয়সী মেয়েটি। ঢাকার খিলক্ষেতে স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। যেদিন সে ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিল, সেদিন ছিল তার কাজের প্রথম দিন। মুদি স্বামী জানে না যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা সুস্থ স্বাভাবিক মেয়েটি মাত্র ২ ঘন্টার মধ্যে চলে গেছে না ফেরার দেশে।
সেদিন শুধু ফারজানা ছাদ থেকে লাফ দেননি, তার সঙ্গে ছিলেন আরও একজন। রিয়া আখতার, যার বয়স ২২ বছর। ভাগ্যক্রমে সে বেঁচে গেছে। প্রশ্ন হলো- প্রয়ান নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও তারা কেন লাফ দিল?
আমি জানি অনেকেই এখন ভাবছেন – যেহেতু এটি একটি ‘স্পা সেন্টার’, তাই খারাপ কিছু ধরা পড়বে। বলেই সে লাফ দিয়েছে। এটা অনেকেই ভাববেন। কারণ আমরা গল্প, নেতিবাচক গল্প এবং সরস গল্প পছন্দ করি। আমরা কী মনে করি – কী সম্ভব এবং কী সম্ভব নয়?
যে মেয়েটি প্রথম দিনে কাজে যোগ দিয়েছিল সে অনৈতিক কিছু করার জন্য গিয়েছিল, তা ভাবা যায় না। ‘স্পা সেন্টার’ সম্পর্কে সবার যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে তা সঠিক নয়, তা জানাও সহজ।
তাহলে প্রশ্ন হলো- তাহলে অভিযান কেন? অভিযানটি ছিল আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক অফিস খোলার বিষয়ে। এসব কারণে তাদের কিছুই হতো না। তবুও তারা লাফ দিয়েছিল। কারণ তারা পুলিশের কাছে ধরার চেয়ে নিজেদের নিথর করাকে সহজ মনে করেছে।
পুলিশের এত ভ”য় কেন? সাহস নিয়ে যখন এই প্রশ্ন জাগে তখন খুব দূরে যেতে হয় না। চট করেই বুশরার নাম মনে পড়লো। বুয়েটের ছাত্র ফারদিনের বান্ধবী হিসেবে পরিচিত বুশরা। নিছক সন্দেহে প্রায় ২ মাস জেলে থাকতে হয়েছে এই মেয়েটিকে।
তাকে মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে। বন্ধুর প্রয়ানে তিনি কাঁদেননি, এই অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। ফারদিনের পরিবার তাকে মামলার প্রধান আসামি করেছে। এই অভিযোগ পাওয়ার পর প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই সর্বোচ্চ গতিতে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শুধু রিমা”ন্ডে নয়, সবার সামনে দিয়েই ২১ বছর বয়সী বুশরাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। কোনো অকাট্য প্রমাণ ছাড়াই মেয়েটির জীবন ও ভবিষ্যৎ অন্ধকার করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, কেন তাকে এভাবে নেওয়া হলো?
ফারদিন আত্মহনন করেছে। এমনটাই জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তাহলে বুশরার জীবন কেন অন্ধকার, কেন তাকে অপমান করা হলো? তাকে হ”/ত্যাকারী হিসেবে আখ্যায়িত করার জন্য দায়ী কে?
এরকম অনেক উদাহরণ আছে। ‘স্পা সেন্টারে’ দুই তরুণী কোন মামলায় ফেঁসে যাবে, কী অপরাধে সাজা হয়ে যাবে, তা জানাও যাবে না। এই অসম্মান আর এই ভয়ের চেয়ে ছাদ থেকে লাফ দেওয়া সহজ মনে করেছে তারা। যে পুলিশ আশ্রয় হওয়ার কথা, তাদের কি আমরা ভয় পেয়েই যাবো, আমাকে নিরাপদ অনুভূতি দেওয়ার কথা তাদের? সেই দিন কবে আসবে যেদিন পুলিশ তাদের তৎপরতা চালানোর আগে ভাববে- যাতে একজন নিরীহ ব্যক্তির জীবন বিপন্ন না হয়? সেই দিন কি আসবে? অপরাধ না করে যদি ভয় নিয়ে বাঁচতে হয়, আমি কি মানুষ নাকি নাকি আজন্ম অপরাধী?
আসলে এই সকল ধারনা মানুষের মনে জন্মায় তো আর এমনি এমি নয়, তাদের আশে পাশে বা সমাজে যা ঘটে থাকে সেখান থেকে তাদের একটি অভিজ্ঞতা সব সময় মনে বাসা বেধে থাকে। পুলিশ কী করে, কাদের আসামি বানায়, লঘু অপরাধ করলেও তাদের যে এজাহার দেওয়া হয় সেটা গুরু করে দেওয়া হয়। এই বিষয়টি এখন মানুষের মনে গেথে গেছে। এটা আদৌ বদলাবে কিনা সেটা এই সময়ে ভাবাও বোকামি।