১৯৯৪ সালের কথা। সেই সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস জুড়ে সেই সময় ছাত্রদলের একচ্ছত্র আধিপাত্য। কঠিন সেই সময় বেশ কঠিন সময় অতিবাহিত করছিল। ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টির কথা দূরে থাক, ছাত্রদলের কর্মীদের ভ’য়ে ছাত্রাবাসে থাকার কোনো রকম সাহস পেতেন না ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
এ সময় মতিউর রহমান তালুকদার যিনি ছিলেন জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তার ছেলে মুরাদ হাসান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। সেই সময় তিনি কলেজের পরিবেশ পরিস্থিতি বোঝার পর বাবার রাজনৈতিক আদর্শ থেকে দূরে সরে এসে নিজের রঙ পরিবর্তন করে ছাত্রদলের সক্রিয় সদস্য হন মুরাদ। তার সক্রিয়তার জন্য তিনি ছাত্রদলের থেকে সেখানকার রাজনীতির মঞ্চ কাঁপানো নেতা বনে যান। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সেখানকার ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে যান। এ সময় কমিটির প্রচার সম্পাদক হিসেবে মুরাদ হাসান ক্ষমতা পেয়ে যান, মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছিলেন যথাক্রমে ডা. মেহবুব কাদির ও ডাঃ মোঃ ইসহাক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মুরাদের প্রচার সম্পাদক হওয়ায় পেছনে কলকাঠি নেড়েছিলেন সেই সময়ের বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসক নেতারা। মুরাদের আচরণ নিয়ে খোদ ছাত্রদলেই তখন দারুণ প্রতিক্রিয়া ছিল।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ক্যাম্পাসে অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে ছাত্রদলের। আধিপত্য শুরু হয় ছাত্রলীগের। ধুরন্ধর মুরাদ তখন তাঁর বাবার পরিচয়ের তকমা লাগিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। সেই সময় অনুনয় করে মুরাদ ছাত্রলীগ নেতাদের জানান, তিনি পরিস্থিতির শি’কার। তিনি আওয়ামী পরিবারেরই সন্তান। এক পর্যায়ে মুরাদ ছাত্রলীগের কমিটিতে যুক্ত হন। পরে দ্রুত পেয়ে যান ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ। সেখান থেকে ২০০০ সালে বনে যান ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি।
ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদার বলেন, ‘মুরাদ বিএনপির শাসনামলে ছাত্রদল করত। পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সে ছাত্রলীগে চলে যায়।’ ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান খোকন বলেন, ‘মুরাদ আওয়ামী লীগ আমলে ময়মনসিংহ মেডিক্যালের সভাপতি ছিল।’
সে সময়ের একাধিক মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর সঙ্গে মুরাদের বিষয়ে দেশের একটি জনপ্রিয় গনমাধ্যমের সাথে কথা হয়। তাঁরা জানান, বর্তমানে তাঁরা সরকারি চাকরি করছেন। অনেকে সিনিয়র হয়ে গেছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তাই মুরাদের বিষয়ে কোনো কথা বলে তাঁরা বিব্রত হতে চান না।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক একাধিক মেডিক্যাল শিক্ষার্থী জানান, মুরাদ ছিলেন ধূর্ত ও পল্টিবাজ। মুরাদ নিজের স্বার্থে বিএনপির সময় করেছেন ছাত্রদল। আবার আওয়ামী লীগের সময় করেছেন ছাত্রলীগ।
২০০১ সালে মুরাদ এমবিবিএস পাস করেন। পরে ২০০৩ সালে আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য হন। এরপর জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হন। ২০০০ সালের পর থেকে মুরাদ এলাকায় এসে সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
সর্বশেষ মুরাদ হাসান জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মুরাদ হাসানকে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাঁচ মাসের মাথায় ২০১৯ সালের ১৯ মে তাঁকে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী করা হয়।
সংসদ সদস্য হয়েই আধিপত্য বিস্তারে এলাকায় গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। ওই সময় তাঁর ক্যাডার বাহি’/নীর তা’ণ্ডবে সরিষাবাড়ীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। এই ক্যাডারদের হাতে উপজেলা আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী লা’ঞ্ছিত হন। তাঁর ক্যাডার বাহিনীর বিরুদ্ধে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন বরাদ্দের টাকা লু’ট করার অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের পদত্যাগ করেছেন এই খবর শোনার পর তার নিজ নির্বাচনী এলাকা জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে আনন্দ মিছিল বের করেন। এ সময় তার প্রতি অসন্তুষ্ট নেতাকর্মীরা মুরাদ হাসানের কুশপুতুল পুড়িয়ে দেয়।
মৌসুমী-শাকিব খানকে নিয়েও তিনি কটু কথা বলতে ছাড়েননি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী মৌসুমী ও চিত্র নায়ক শাকিব খানকে নিয়ে তিনি আপত্তিকর মন্তব্য করেন যেটা নিয়ে তিনি নেট জগতে আলোচনায় উঠে আচেন। কিন্তু সেই সময় তার ক্ষমতার দাপটে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহস করেননি কোনো অভিনেতা অভিনেত্রী। অক্টোবরের শেষ দিকে ‘স্বপ্নের রাজকুমার’ সিনেমার শুভ মহরত অনুষ্ঠানে ছবির অভিনেত্রী মৌসুমীর ওজন ও দৈহিক গড়ন নিয়ে কথা বলেন মুরাদ হাসান। এছাড়া গেল ৩০ নভেম্বর ‘ময়ূরাক্ষী’ নামক সিনেমার মহরত অনুষ্ঠানে শাকিব খানের শারীরিক গড়ন ও অভিনয় নৈপুন্যতা কটুক্তি করেন মুরাদ হাসান। তিনি শাকিব খানকে তেলাপোকার সাথে তুলনা করেন।
এই প্রতিবেদন তৈরীতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিবর্গরা।