দলীয় সমর্থন যদি না পান তাহলে সংসদ সদস্য হিসেবে যে পদটি রয়েছে সেটি হারাবেন ড. মুরাদ হাসান। প্রতিমন্ত্রীর পদ হারানোর মাধ্যমে মুরাদ হাসান বর্তমানে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী যিনি সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা তার অবস্থানে পৌঁছেছেন। এদিকে আওয়ামী লীগের জামালপুর জেলা কমিটি মুরাদ হাসানকে কমিটি হতে বহিষ্কার করার পর সেটা অনুমোদন করানোর জন্য কেন্দ্রে পাঠিয়েছে।
নারীদের প্রতি অবমাননাকর ও অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে মন্তব্য করার জন্য মন্ত্রিত্ব হারিয়ে ফেলা ড. মুরাদ হাসান এমপি হিসেবে থাকবেন কিনা সেটা নিয়েও এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা মনে করছেন, মুরাদ হাসানের সাংসদের পদটিও থাকা উচিত নয়।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে সব দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা এবং মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের পর এমপি পদ হারানো বা বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার উদাহরণ। গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ও রাজশাহীর কাটাখালীর সাবেক মেয়র আব্বাস আলী স্থানীয় সরকারে এমন ধরনের উদাহরণ। দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে মেয়র পদ হারান তারা।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক দেশের একটি গনামাধ্যমকে বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি দল থেকে পদত্যাগ করেন তাহলে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে তাঁর সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। সংবিধানের ৬৬(২) অনুসারে সংসদ সদস্য হওয়ার বা থাকার অযোগ্যতা বিষয়ে যে কারণগুলো আছে, তাতেও দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি নেই। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংসদ সদস্য পদে থাকার যোগ্যতা নিয়ে কোনো বিত’র্ক উঠলে সংসদ সদস্য বিরোধ নিষ্পত্তি আইন, ১৯৮১ অনুসারে জাতীয় সংসদের স্পিকার তা নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠাতে পারেন।
শাহদীন মালিক বলেন, ‘বিতর্কিত মন্তব্য বা কর্মকাণ্ডে দল থেকে বহিষ্কার হলেও গাজীপুরের জাহাঙ্গীর আলম ও রাজশাহীর কাটাখালীর আব্বাস আলীকে ওই কারণ দেখিয়ে মেয়র পদ থেকে অপসারণ করা হয়নি। এ অবস্থায় সদ্য পদত্যাগকারী তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বিষয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা জানার জন্য আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে।’
২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রবাসী বাংলাদেশিদের এক অনুষ্ঠানে পবিত্র হজ ও তাবলিগ জামাত সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে নিন্দা-ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলেন। তিনি পদত্যাগ না করায় সংবিধানের ৫৮(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে তাঁর মন্ত্রিত্বের অবসান ঘটানো হয়। একই দিনে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং দলীয় প্রাথমিক সদস্য পদ বাতিল করা হয়।
এরপর ২০১৫ সালের ৫ জুলাই লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ বাতিলের ব্যবস্থা নিতে দলের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। স্পিকার বিষয়টি নিষ্পত্তি করে সিদ্ধান্ত জানানোর অনুরোধ জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) চিঠি দেন।
লতিফ সিদ্দিকীকে শুনানির জন্য নোটিশ পাঠায় নির্বাচন কমিশন। নোটিশের কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। রিট আবেদনে চিঠিটি কেন অবৈধ ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুলের আরজিও জানিয়েছিলেন। বিচারপতি এমদাদুল হক ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রিট আবেদনটি খারিজ করে দেন বিচারপতি মো. হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালতে লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে আপিল করেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। সেই আবেদনও খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ। লতিফ সিদ্দিকীকে নির্বাচন কমিশনে যেতে বলে সুপ্রিম কোর্ট।
এরপর লতিফ সিদ্দিকী নির্বাচন কমিশনের শুনানিতে হাজির হয়ে বলেন, ‘শুনানির প্রয়োজন নেই। আমি সংসদ থেকে পদত্যাগ করব।’ ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। ওই দিন তিনি সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়ে বলেন, ‘আজ আমার সমাপ্তি দিন। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ জানাচ্ছি না, নত মস্তকে ক্ষমা চাচ্ছি সবার কাছে। আমার নেত্রীর অভিপ্রায়, আমি সংসদ সদস্য না থাকি। কর্মী হিসেবে নিয়ত নেতার একান্ত অনুগত ছিলাম। বহিষ্কৃত হওয়ার পর এর ব্যত্যয় কিংবা ব্যতিক্রম সমীচীন মনে করি না। হৃষ্টচিত্তে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের আসন ১৩৩, টাঙ্গাইল-৪ সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করছি।’
এই বাস্তবতায় ডা. মুরাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে, তা মূলত আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। তবে মুরাদের পদত্যাগের পর গতকাল সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সংসদ সদস্য পদের বিষয়ে স্পিকার সিদ্ধান্ত নেবেন। এখন আপাতত যেটা হয়েছে, তিনি একজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, তাঁকে সে পদ থেকে সরে যেতে হলো। দলের একটা পদ থেকেও তিনি অব্যাহতি পাচ্ছেন। এমপি পদের বিষয়েও যদি সে রকম গুরুতর কোনো অভিযোগ আসে, সেটা স্পিকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
মুরাদ হাসানের দলের প্রাথমিক সদস্য পদও বাতিল হবে কি না—জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এ বিষয়ে দলের পরবর্তী ওয়ার্কিং কমিটিতে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা গাজীপুরের মেয়র এবং ওই মহানগরের সাধারণ সম্পাদকের ব্যাপারে এভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং ছাড়া গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। আমরা পরবর্তী ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তাঁর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’
সংসদ সদস্য বিরোধ নিষ্পত্তি আইন, ১৯৮১-এ বলা আছে, কোনো সাংসদের সদস্য পদ নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে বিরোধ তৈরি হওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে স্পিকার তা শুনানি করে নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। কমিশন স্পিকারের বিবৃতি পাওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে বিষয়টি যাঁকে নিয়ে বিরোধ তাঁকে ও বিরোধ উত্থাপনকারী পক্ষকে তাদের বক্তব্য লিখিতভাবে দেওয়ার নির্দেশ দেবে। বক্তব্য পাওয়ার পর কমিশন উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে ১২০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাবে।
অন্য নজিরও আছে : সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো সংসদ সদস্য দল থেকে পদত্যাগ করলে বা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তাঁর সদস্য পদ থাকবে না। এই অনুচ্ছেদবলে অষ্টম সংসদে তৎকালীন সরকারি দলের (বিএনপি) সংসদ সদস্য আবু হেনার সদস্য পদ স্বতন্ত্র হিসেবে বহাল থাকে। ওই সংসদে সরকারবিরোধী বক্তব্য দেওয়ায় আবু হেনাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, কিন্তু বিএনপি সে সময় তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিলের বিষয়ে স্পিকারকে কোনো চিঠি দেয়নি।
এর আগে সপ্তম সংসদে বিএনপির সাংসদ আখতারুজ্জামান দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে সংসদে যোগ দিলেও দল থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর সংসদ সদস্য পদ থাকবে কিনা তা নিয়ে বিরোধ নিরসনের জন্য স্পিকার তা নির্বাচন কমিশনে পাঠান। কমিশন জানায়, আখতারুজ্জামান সংসদীয় দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদে যোগ দেন। এরপর তার সদস্যপদ বাতিল করা হয়।
জাতীয় পার্টি থেকে এইচ এম গোলাম রেজাকে বহিষ্কার করা হলেও নবম সংসদে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবেই ছিলেন। তৎকালীন স্পিকার তার মামলা নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনে তার বিষয়ে কোনো নথিও পাঠাননি।
এমতাবস্থায় মুরাদ হাসান সংসদ সদস্য থাকবেন কি না সেটা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের শীরষপর্যায়ের সিদ্ধান্তের ওপর। মাহবুবুল হানিফ যিনি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন তিনি গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন ড. মুরাদ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে খুবই লো প্রোফাইল দেখিয়েছেন। এ ধরনের কোনো ব্যক্তির সংগঠনে কোনো দায়িত্বশীল পদে থাকাবার কোনো সুযোগ নেই। তিনি আরো জানান, পরবর্তী সময়ে দলের যে কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে সেখানে তাকে অপসারণের সুপারিশ করা হবে।