সত্যি বলতে, গত বেশ কয়েক দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডা. মুরাদ হাসান যেসব বক্তব্য দিচ্ছিলেন সেগুলো আমাকে অনেক অস্থির করে তুলেছিল। শুধু তার বিষোদগার বক্তৃতা নয়, তার বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডও বর্তমান সময়ে উদ্বেগ এবং ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী, তিনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। শুধু তাই নয়, তিনি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একজন। সেই হিসেবে তিনি যেসব কথাবার্তা বলবেন ও আচরণ সাধারণ মানুষের সামনে করবেন সেটা দিয়ে মানুষের মাঝে ভালোবাসা ও আস্থার জায়গা তৈরি করবেন।
তিনি সকলের কাছে হয়ে উঠবেন একজন রোল মডেল এবং অন্যদের কাছে সম্মানিত ব্যক্তি। তবে সেটা না হয়ে এই মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য ও আচরণ এতটাই বিতর্কিত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে তা ভাষায়ও প্রকাশ করা সম্ভাবপর নয়। মঞ্চে দাঁড়ানোর পর তিনি কেমন যেন অকারণেই গর্জে উঠতে শুরু করেন। বিরোধী দলকে নিয়ে কথা বলতে হয়, তাই যেন ধোলাই করতে শুরু করেন। তিনি যেসব কথাবার্তা গর্ব করে বলেন, সেটা শুনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে নারীরা বিব্রত হয়। মেয়েদের ফিগার নিয়েও কথা বলেন। মঞ্চে নাচ-গানও করেন। কোন ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারী তিনি, অনেকের নিকট সেটা একটা প্রশ্ন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নাতনি জাইমা রহমান সম্পর্কেও কোনো কারণ ছাড়াই বিরূপ মন্তব্য করলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার এই সব বিতর্কিত কর্মকাণ্ড দেখে দেখে একটাই প্রশ্ন মনের ভেতর উঁকি দিচ্ছিল তা হলো- সবকিছুর শেষ বলে একটি কথা আছে। তবে এই ভদ্রলোকের ক্ষেত্রে শেষ বলে আদৌ কী কিছু আছে? পাশাপাশি একথাও মনে হচ্ছিল, পিপীলিকার পাখা হয় মরিবার তরে… উপমাটাতো আর এমনি এমনি তৈরি হয়নি। এই উপমাটাই বোধকরি শেষমেশ কাজে লাগল।
তবে হ্যাঁ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণেই একজন মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর অশোভন, অনৈতিক, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেয়েছে। দুই বছর আগের ঘটনা। মাননীয় তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান একজন চিত্রনায়িকার সাথে মোবাইল ফোনে অশ্লীল, কদর্য ও আপত্তিকর বাক্য বিনিময় করেন। গভীর রাতে তাকে হোটেলে আসার জন্য চাপ দেন। তার কথা না শুনলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বা’হিনীর মাধ্যমে জোর করে উঠিয়ে আনবেন বলে ভয়ও দেখান। দুই বছর পর মুরাদ হাসানের এই টেলিফোন সংলাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলো। এই ধরনের ঘটনায় সাধারণত কী হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তি ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন, এই টেলিফোন সংলাপ আমার নয়। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কেউ এই অডিও সংলাপ ছেড়ে দিয়েছে। মুরাদ হাসান একজন প্রতিমন্ত্রী। তার বেলায়ও এই ধরনের মিথ্যা প্রতিবাদ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। পাপ কখনও চাপা থাকে না… পাপ বাপেরেও ছাড়ে না… মুরাদ হাসান এত জঘন্য পাপ করেছেন যে মিথ্যায় মোড়ানো প্রতিবাদ করারও সুযোগ পেলেন না। বিতর্কিত টেলিফোন সংলাপের অপর দুই ব্যক্তি চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি ও চিত্রনায়ক ইমন স্বপ্রণোদিত হয়েই সত্য প্রকাশ করেছেন। মাহিয়া মাহি এখন সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরীতে রয়েছেন। ওমরাহ পালন করতে গেছেন। সেখান থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, আমি পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। আল্লাহ স্বাক্ষী আমার কোনো দোষ ছিল না। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ এই ঘটনার বিচার করবেন…
প্রশ্ন উঠেছে দুই বছর আগের অডিও সংলাপ হঠাৎ প্রকাশ করল কে? এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, কোন দেশে বাস করি রে ভাই, তথ্য প্রতিমন্ত্রীর অডিও সংলাপও চাপা থাকে না। হা: হা: হা:
তবে একথা সত্য অডিও সংলাপটি এভাবে প্রকাশ না হলে একজন প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রীর কদর্য চেহারাও জাতির সামনে প্রকাশ হতো না। এজন্য আবারও ধন্যবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। একই সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও ধন্যবাদ যে, তিনি তাৎক্ষণিকভাবেই তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। তার এই উদ্যোগের প্রশংসা করছেন দেশের মানুষ।
আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান শরীফে উল্লেখ আছে নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা লংঘনকারীকে পছন্দ করেন না। প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান সত্যিকার অর্থে সীমালংঘন করেছেন। তবে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান অন্যদের বেলায় দৃষ্টান্ত হতে পারেন। সতর্কতার দৃষ্টান্ত। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন যিনি তিনি কি কখনও ভেবেছিলেন তার বিতর্কিত অডিও সংলাপও একদিন ফাঁস হয়ে যাবে? কথার কথা। ধরা যাক মুরাদ হাসানের অডিও সংলাপটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হয়নি। অথচ চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ফোনে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুললেন। ধোপে টিকবে এই অভিযোগ? অডিও সংলাপের জ্বলন্ত প্রমাণ হাতে আছে বলেই না মাহি একজন প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মুখ খুললেন।
আবারও বলি পাপ কখনও চাপা থাকে না। তার জ্বলন্ত প্রমাণ মুরাদ হাসানের অডিও সংলাপ। একজন মানুষের মুখের ভাষা কতটা কুরুচিপুর্ণ হতে পারে তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মুরাদ হাসান। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুরাদ হাসানের বক্তৃতার ঢং, শারীরিক অঙ্গভঙ্গিই বিতর্কের জন্ম দেয়। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাতনি জাইমা রহমান সম্পর্কে মুরাদ হাসানের অশোভন মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সম্পর্কেও তিনি আপত্তিকর মন্তব্য করেন। সর্বশেষ চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সাথে তার অশোভন ও কুরুচিপূর্ণ টেলিফোন সংলাপ ফে’সবুকে ভাইরাল হওয়ায় ক্ষমতার মসনদ থেকে ছিটকে পড়লেন তিনি।
শেষ খবরে যেটা জানা গিয়েছে সেটা হলো, মুরাদ হাসান ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের একজন নেতা ছিলেন তাও একটি মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকাকালীন। সেক্ষেত্রে নি:সন্দেহে তিনি মেধাবী একজন ব্যক্তি। কিন্তু তার আচরনে সেটা প্রকাশ পায় না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর নিজেই এই ধরনের তথ্য সামনে এনেছেন। বিএনপি ও জামায়াত ছাড়ার পর অনেকেই ক্ষমতার লোভে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগে চলে এসেছেন এরা সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী। তাই ডা. মুরাদ হাসান যেটা করেছেন এটা কোনো জরুরি প্রশ্ন নয়। তবে জরুরী প্রশ্নটা হলো, মুরাদ হাসানের অনৈতিক ঘটনাটি প্রকৃত অর্থে কী ধরনের বার্তা দিচ্ছে, সেটা থেকে আমরা কি শিখলাম? অন্যান্য রাজনৈতিক দলে যারা ছিলেন, যারা বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন এবং যোগ দিচ্ছেন তারা আসলেই আওয়ামী লীগের নীতি আদর্শকে কতটা শ্রদ্ধা করেন? এনারা কী আবার দল থেকে চলে যাবে না? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর কি? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ন যেটা বিবচনারও বিষয়।
লেখনীতে কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।