অভিনেত্রীদের চিরবিদায় ভক্তদের হৃদয় ভেঙে যায়। শূন্যতায় সৃষ্টি করে পরো বিনোদন জগতকে।যদিও মৃ/ত্যু মানুষের অনিবার্য তবুও যেন কেউ মিনে নিতে পারে না।জিনাত বরকতুল্লাহ মতো অভিনেত্রীকে হারিয়ে তার সমকর্মীরাসহ অনেকে শোকাহত।বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন লেখিকা মিলি সুলতানা পাঠকদের জন্য হুবহু পাঠকদের জন্য নিচে দেওয়া হলো।
দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে গিয়ে সেলফোন হাতে নিতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার প্রিয় নৃত্যশিল্পী যাকে নৃত্যের বিভাবরী ও জাদুকরী আইকন বলা হত সেই জিনাত বরকতুল্লাহ পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। দুপুরের খাবারটা ঠিকঠাকমত খেতে পারলাম না। বারবার ভাবছিলাম বিজরী কাজরী দুইবোনের কথা। মা’কে হারিয়ে বিজরী কাজরী নিশ্চয়ই শোকে পাথর। ২০২০ সালের ৩ আগস্ট তারা হারিয়েছে তাদের বাবা বিটিভের সাবেক নাট্য প্রযোজক এবং মহাব্যবস্থাপক জনাব মোহাম্মদ বরকতুল্লাহকে। এই গুণী ব্যক্তি জীবনঘাতি বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়া রোগের কবল থেকে রেহাই পাননি। যখন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ মা/রা যান তাঁর মৃ/ত্যুর খবর স্ত্রী জিনাত বরকতুল্লাহ জানতেন না। কারণ জিনাতও বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়া রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তবে প্রথমে জিনাত বরকতুল্লাহ’র কো/ভিড পজিটিভ ধরা পড়েছিল। তার কয়েকদিন পর আক্রান্ত হলেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস!! বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়া রোগে ভূগে গ্রীনলাইফ মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জনাব বরকতুল্লাহ। তাঁর ভালবাসার মানুষটিও (জিনাত বরকতুল্লাহ) একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতালে ক্রিটিকাল কন্ডিশানে ছিলেন বলে প্রিয়তম স্বামীর মৃ/ত্যুর বিষয়ে অবগত ছিলেন না জিনাত। তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। বিটিভির যুগে কয়েকটি ধারাবাহিক নাটক কালজয়ী অধ্যায় রচনা করেছিল। কোথাও কেউ নেই, ঢাকায় থাকি, সকাল সন্ধ্যা এবং নক্ষত্রের রাত। “কোথাও কেউ নেই” এর ঐতিহাসিক চরিত্র বাকের ভাইয়ের কথা ভুলি কিভাবে??
তখন আমরা ছোট ছিলাম। আশির দশকে বিনোদন বলতে বিটিভিই একমাত্র ভরসা ছিলো। আতিকুল হক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনদের নির্মিত নাটকের দিকেই আমাদের সব আকর্ষণ ছিলো। আমার বাল্যকালের সুখস্মৃতি জাগানিয়া ধারাবাহিক নাটক “সকাল সন্ধ্যা”র শাহেদ (পীযূষ বন্দোপাধ্যায়), শিমু (আফরোজা বানু), শাকেরার (রিনা সুলতানা) কথা আজো ভুলিনি। “সকাল সন্ধ্যা”য় আরেকজন গ্ল্যামারাস অভিনেত্রীকে খুব ভালো লাগতো। তার নাম সম্ভবত ইশরাত জাহান ঝুমুর (অভিনেতা খুরশিদুজ্জামান উৎপলের স্ত্রী)। “ঢাকায় থাকি”র তারানা হালিম, ডব্লিউ আনোয়ার (যিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন আলীরাজ নামে), হুমায়ূন আহমেদের “কোথাও কেউ নেই”র সুবর্ণা মোস্তফা এবং বিখ্যাত বাকের ভাইয়ের (আসাদুজ্জামান নূর) দুর্দান্ত চরিত্র আমাদের বাস্তব জীবনকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। বিটিভির এই কালজয়ী ধারাবাহিক নাটকের প্রযোজক ও নির্মাতা ছিলেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ।
ছোটবেলায় বিটিভির কোনো নৃত্য্যানুষ্ঠান মিস করতাম না। শামীম আরা নিপা, জিনাত বরকতুল্লাহর নাচের খুব ভক্ত ছিলাম। জিনাত বরকতুল্লাহ’র একটা স্মরণীয় নাচের কথা আজো মনে পড়ে। “আমি বনফুল গো ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো”— এই গানের সাথে রূপসী জিনাত বরকতুল্লাহ’র সেকি অসাধারণ মনোমুগ্ধকর নাচের মুদ্রা। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ ও জিনাত সোনায় সোহাগা জুটি ছিলেন। অপার সুন্দরের মিশেল ছিলেন এই জুটি। বাবাকে হারানোর পর মা’কে আগলে রেখেছিলেন বিজরী কাজরী দুইবোন। আজ সেই মা’কে তাদের হারাতে হয়েছে। জিনাত বরকতুল্লাহ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির একজন পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি প্রায় ৮০টি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছেন। ১৯৮০ সালে “মারিয়া আমার মারিয়া” নাটক দিয়ে তার অভিনয় জীবন শুরু হয়। পরে তিনি ঘরে বাইরে, অস্থায়ী নিবাস, বড়বাড়ি, কথা বলার ময়না- নাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী গানের সঙ্গ, নৃত্যচল এবং বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার অন্যতম উপদেষ্টা। একুশে পদকপ্রাপ্ত জিনাত বরকতুল্লাহর শৈল্পিক গুণাবলী আজো দক্ষিণ এশীয় নৃত্যের অনন্যসাধারণ সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। এই গুণীজনের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।