রায়ান (৮) ঘুম থেকে ওঠার আগেই মাকে হারান। দুই বছর আগে ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জের হজরতপুর ব্রিজ থেকে মা ঢাকাই চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রাইমা ইসলাম শিমুর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যার অভিযোগে শিশুটির বাবা সাখাওয়াত আলী নোবেল কারাগারে রয়েছেন। ফলে রায়ান এক অর্থে তার বাবার পাশাপাশি তার মাকেও হারান। তিনি তার খালা (শিমুর বোন) ফাতেমা বেগমের কাছে আশ্রয় নেন।
সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ফাতেমা বেগমের। তিনি বলেন, ‘রাইয়ান সবসময় তার মাকে খুঁজছে। আমরা মানে- তোমার মা ঈশ্বরের কাছে চলে গেছে। এবং তাকে দেবদূত বানিয়ে আমাকে দিয়েছিলেন। সে এখন আমার মধ্যে তার মাকে খোঁজে। কিন্তু আমিও একজন মা। আমারও একটি সন্তান আছে। আমি বুঝতে পারছি সে তার মাকে কতটা মিস করে!’
১৯৯৮ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘বর্তমান’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে বরিশালের মেয়ে রাইমা ইসলাম শিমুর। এরপর একে একে 23টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। রিয়াজ, অমিত হাসান, বাপ্পারাজ, জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, শাকিব খানসহ অনেক গুণী ও জনপ্রিয় অভিনেতার বিপরীতে অভিনয় করেছেন তিনি। ২০০৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জামাই স্বশুর’ ছবিতে তাকে শেষ দেখা গিয়েছিল। অন্য কোনো ছবিতে কাজ না করলেও বেশ কিছু টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন।
২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি সকাল ১০টায় কেরানীগঞ্জ থেকে শিমুর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শিমু হত্যার ঘটনায় তার ভাই হারুনুর রশিদ বাদী হয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করেন। এরপর শিমুর স্বামী সাখাওয়াত আলী নোবেল ও তার বন্ধু এসএম ফরহাদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পরিদর্শক শহিদুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত করে ওই বছরের ২৯ আগস্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। 29 নভেম্বর, 2022 তারিখে, আদালত তাদের অভিযুক্ত করে বিচার শুরু করার নির্দেশ দেয়। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শফিকুল আলমের আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।
মামলায় এ পর্যন্ত ৩৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ১২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। মামলার শেষ শুনানি হয় গত বছরের ২ নভেম্বর। কিন্তু সেদিন কোনো সাক্ষ্য ছিল না। আগামী ২৫ জানুয়ারি শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়েছে। আসামিরা বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।
শিমুর বোন ফাতেমা বেগম বলেন, ‘আমি আমার বোনকে হারিয়ে দুই বছর হয়ে গেল। আমৃত্যু যা হয়েছে তা আমি ভুলব না। মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ চলছে। আমরা ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা করছি। বাকিটা আল্লাহর উপর নির্ভর করে।
রহস্যজনকভাবে খুন হওয়া এই অভিনেত্রী স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর গ্রিন রোড এলাকার একটি বাড়িতে থাকতেন। বড় সন্তানের নাম ওজিহা, ছোটটির নাম রায়ান। ফাতিমা বেগম শিমুর মেয়ে ওজিহার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘সে বড়, সব বোঝে। অনেক ব্যাথা লাগে। কেন তার সাথে এমন ঘটনা ঘটল? সে তার মাকে খুব মিস করে, বলতে থাকে- কেন তার সাথে এমন হলো? সে তার মাকে কোথায় পাবে? যখন তার মায়ের কথা মনে পড়ে, সে আমাকে জড়িয়ে ধরে তার খোঁজ করে।
এবং ছোট রায়ান এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারে না। ফাতেমা বেগম বলেন, ছেলেটা ছোট, বোঝে না। সেও তার মাকে খুঁজছে। আমাকে মা বলে ডাকলেও মা তো মা। মাকে মিস করছি, কথা বললে বুঝতে পারি। তার সামনেই তার মাকে হত্যা করা হয়। তার মা বললেন, আমাকে বাঁচাও। এই কথাটি সে আজও ভুলতে পারেনি। তিনি রুমে ছিলেন এবং ঘটনাটি দেখেন। জেগে উঠে তার বাবা নোবেল পরে তাকে মারধর করে। সে আবার শুয়ে পড়ল। ওর মা বলল- রায়ান আমাকে বাঁচাও। তিনি তার স্মৃতি থেকে এটি মুছে ফেলতে পারবেন না। কিন্তু আমরা মুছে ফেলার চেষ্টা করছি।
তিনি বললেন, রায়ান আমাকে ছেড়ে কোথাও যায় না। মামার বাড়িতে গেলেও একদিন পর বলে- মায়ের কাছে যাবে। আমি অসুস্থ হলে, রায়ান আমার বাচ্চার চেয়ে বেশি বিরক্ত হয়। মা জিজ্ঞেস করে খালামনির জন্য এত অস্থির কেন? সে বলে- না না। আমি একজন মাকে হারিয়েছি, এই মায়ের কিছু হলে তাকে কোথায় পাব? অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। বুঝলাম বাবার প্রতি তার অনেক অভিমান আর অভিযোগ আছে। আর এটাই স্বাভাবিক। চোখের সামনে বাবাকে মাকে খুন করতে দেখেছে। সেই থেকে বাবাকে বাবা বলা হয় না। নোবেল বলা হয়। বলে- নোবেল আমার মাকে মেরেছে। এটা কোনো শিশুর ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
রাইমা ইসলাম শিমুর পুরো পরিবারে শোকের মাতম। ফাতেমা বেগম বলেন, ‘মা তুমি (শিমু) যে খাবার খেতে পছন্দ কর তা খেতে পারবে না। সে খাবারের জন্য কাঁদছে। মা তার মেয়েকে হারিয়েছে, আমি বোনকে হারিয়েছি, ওজিহা ও রায়ান তাদের মাকে হারিয়েছে। যাই হোক আমরা আশাবাদী, আল্লাহ সুবিচার দিবেন। আর আইনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ার সরদার বলেন, “আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আশা করছি, তারা সর্বোচ্চ সাজা পাবে। নিহতের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে। চলতি বছরেই মামলার বিচার শেষ হবে এবং ভিকটিম তার ন্যায়বিচার পাবে।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, রাষ্ট্র অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের আশা এ মামলায় আসামিরা খালাস পাবেন।