ক্ষমতার পরিবর্তনের সাথে সাথে সরকার আসে এবং যায়। কিন্তু সরকারি সচিব-আমলা-কর্মচারীদের আসন স্থায়ী। অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ‘মন্ত্রণালয় চলে সচিবদের দ্বারা, মন্ত্রীরা নয়’ এই প্রচলিত কথাটি প্রায় শতভাগ সত্য। একটি সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয় এবং ক্ষমতায় আসে। সংসদ, মন্ত্রী, এমপি সবাই জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। তবে এসব জনপ্রতিনিধির চালক সচিব-আমলারা। সংসদ সদস্যরা জাতীয় সংসদে জনগণের পক্ষে কথা বলেন। সেখানে আইন প্রণয়ন, বাজেট থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর এসব বিষয় বাস্তবায়নের জন্য সবার আগে প্রয়োজন আমলা-সচিব। মন্ত্রী, সাংসদরা স্কিমের চূড়ান্ত স্বাক্ষরকারী মাত্র।
আরও সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয়, ‘জনপ্রতিনিধিদের একা কোনো প্রকল্প বা সরকারি কর্মকাণ্ড করার সুযোগ নেই। কারণ জনপ্রতিনিধিরা সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক নিয়মনীতির কারণে আমলাতান্ত্রিক। যেমন একজন মন্ত্রী তার ইচ্ছানুযায়ী ফাইলে স্বাক্ষর করলে কাজ হয় না। বরং সরকারের সচিব-আমলা, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন তার চিন্তা কতটা যুক্তিযুক্ত। এই প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারণে সরকারের উদ্দেশ্য কার্যকর করতে একজন সচিবের বিচক্ষণতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
2024 সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতি পুরোদমে চলছে। এই নির্বাচনকে ঘিরে আমলাদের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে। কারণ, দীর্ঘদিনের আওয়ামী সরকারের একটি বিশেষ অংশ হলো সচিব থেকে কর্মকর্তা পর্যন্ত সরকারি আমলারা। আর এই সরকারের কাঁধে ভর করে যে দুর্নীতির পাহাড় গড়েছে তার প্রমাণ পেয়েছে দেশের মানুষ। সহজ কথায়, আওয়ামী সরকার আবার ক্ষমতায় আসা সরকারি আমলা, সচিব, পুলিশ সদস্যদের জন্য সুবিধাজনক। এতে করে তারা নিজেদের মতো করে সরকার চালাতে পারে। অতীতে দেখা গেছে আমলাতান্ত্রিক সচিবনির্ভর আওয়ামী সরকারের কাছে দলীয় নেতা-কর্মীদের চেয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভোট এখন সরকারি বাহিনী তাদের ক্ষমতা দিয়ে করতে পারে। নেতাকর্মীরা ভোটে না গেলেও। গত নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে।
আওয়ামী সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলেও জনগণের একমাত্র নির্ভরতার জায়গা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এলাকার নির্বাচিত মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে মানুষের মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের ক্ষোভ ও আক্ষেপ। আবার সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়ায় নীরব ভূমিকা পালন করছেন দলের বিদ্রোহী নেতাকর্মীরা। আর সেই সুযোগে সুবিধাবাদী চরিত্রের লোকজন দলে দলে ভিড় জমাচ্ছেন। তারা আমলা, মন্ত্রী-এমপিদের হাতে আওয়ামী লীগের সিলমোহর লাগিয়ে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে আমলাদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। দল ও দলের কর্মীদের দুর্নীতিমুক্ত রাখতে গিয়ে আমলাদের দুর্নীতি যে সীমাহীন আকারে বাড়ছে তা জনগণ এখন বুঝতেও পারছে না। কারণ সরকারি কর্মকর্তারা প্রতি মুহূর্তে নিজেদের আওয়ামী সমর্থক হিসেবে প্রমাণ করছেন।
ফলে দেশের প্রতিটি সেক্টরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সরকার ও জনগণ। যদিও সরকার বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলে আসছে। এই সরকারের আমলে দুর্নীতির কথা বললে জনগণকে মামলার স্বীকার হতে হয়েছে, এটা দুঃখজনক। কারণ সরকার আমলাদের ওপর নির্ভরশীল। আমলাতান্ত্রিক অনিয়ম ও দুর্নীতি সরকারের প্রধান দুর্বলতা।
গ্রামীণ প্রবাদে বলা হয়, ‘শেয়ালকে মুরগি দেওয়া’ ঘটনাটি ঘটেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা ডিজিটাল বাংলাদেশ বা সোনার বাংলা, সরকারি কর্মকর্তারা খিচুড়ি প্রশিক্ষণ, বালিশ ও কম্বলের জন্য বিদেশ ভ্রমণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছেন, যার জন্য সরকারের প্রতি জনগণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে নীরবে। চাপা কিন্তু সরকার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় কর্ণপাত করেনি। তার কারণ, গত নির্বাচনে সরকারি আমলাদের সচিবরা জনগণের ভোটের তোয়াক্কা না করে আওয়ামী সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছিলেন। যা ২০২৪ সালের নির্বাচনে ঘটতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ যদি বুঝত আমলা সচিবদের ব্যক্তিগত স্বার্থে দীর্ঘস্থায়ী সরকার দরকার, তাহলে জনগণের কাছে যাওয়ার অনেক সুযোগ থাকত।
২৮ অক্টোবর সংহিতা ঘটনার পর থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের নানা ঘটনা ঘটেছে যা অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রহণযোগ্য। বিএনপির তালিকা তৈরি করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও গ্রেপ্তার করার বিষয়টিও মানুষের মনে ছবি আঁকছে। এই গ্রেফতারের কারণ দেখিয়ে বিভিন্ন এলাকায় আর্থিক লেনদেন করছে দুর্নীতিবাজ শক্তি ও ব্যক্তিরা। শেখ হাসিনার সরকারের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা অনেক আগেই লাগাম দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তারা তা করেনি। তবে আগামীতে ক্ষমতায় এলে সবার আগে এটা করতে হবে। তা না হলে দীর্ঘমেয়াদে এই সরকারের প্রতি জনগণ আস্থা হারাবে।
সরকার যেমন জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে দেশ ও জনগণের সেবায় কাজ করে, তেমনি সরকারি আমলা, কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও জনগণের সেবক। তারা জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে বেতন-ভাতাসহ সব সুবিধা ভোগ করে। তাই আমলাদের ওপর ভরসা করার আগে সরকারের উচিত জনগণের ন্যায্য অধিকার পাওয়ার কথা ভাবা। জনগণের মতামতের মূল্যায়ন করে দেশকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হলে সবার আগে আমলাদের দুর্নীতি রোধ করতে হবে। তা না হলে আমলাদের কথাই সত্যি প্রমাণিত হবে, ‘আমলারা দেশ চালায়, সরকারকে ক্ষমতায় আনে। ভোটের জন্য জনগণ, দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রয়োজন নেই।
যদি সরকারি ব্যবস্থাপনাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, তাহলে এর জন্য সরকারি কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধি উভয়েরই সম্পৃক্ততা ও সমন্বয় প্রয়োজন। সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক কাঠামোতে শুধু জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে সরকারের পক্ষে দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করা সম্ভব নয়। সমস্যা হলো বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যেও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। তারাও দুর্নীতিমুক্ত নয়। এ কারণে দেশের উন্নয়নের ধারায় আমলা ও জনপ্রতিনিধি উভয়কেই দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। সরকারকে চেইন দিয়ে কাজ করতে হবে। অনিয়ম-দুর্নীতির শৃঙ্খলে মরিচা পড়ে গেলে সরকারকে তা মেরামত করতে হবে। কারণ দিনশেষে সব দায়িত্ব নিতে হয় জনগণের নির্বাচিত সরকারকেই। সেখানে আমলারা লুকিয়ে থাকে কারণ তারা জনগণের প্রতিনিধি নয়। তাই আওয়ামী লীগের উচিত আমলাতান্ত্রিক ভোটের মাধ্যমে সরকার হিসেবে ক্ষমতায় আসার চিন্তা ত্যাগ করে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠনের পথে হাঁটা। কারণ জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিবেশ তৈরি করে একটি গণমুখী সরকার গঠন করাই দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গলজনক।