মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশের মানুষ বিশাল আত্মত্যাগ করেছে। আর মুক্তিযোদ্ধা তাদের জীবন দিয়ে এদেশের মানুষকে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে নাম লিখিয়েছে।অথচ অনেক ক্ষেত্রে তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন লেখিকা মিলি সুলতানা হুবহু পাঠকদের জন্য নিচে দেওয়া হলো।
গত কিছুদিন ধরে নিউইয়র্কের বাঙালি কম্যুনিটিতে একটি বিতর্কিত ঘটনা নিয়ে বেশ ঝামেলা শুরু হয়েছে। যাকে নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি তিনি হলে আখতার আহমেদ রাশা। তিনি একজন ভাস্কর। বাংলাদেশি কম্যুনিটির একজন গুণী এবং সজ্জন ব্যক্তি। তার আইডল হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। আখতার আহমেদ রাশা সাহেব অনেকগুলো শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন। নিউইয়র্ক প্রবাসী মিডিয়াকর্মী কৌশিক আহমেদসহ কয়েকজন তাদের নিজস্ব পত্রিকায় রাশা সাহেবের ভাস্কর্য শিল্পকে বেশ ফলাও করে প্রচার করেছেন। চারদিকে শুধু প্রশংসার প্লাবন।আর সেই প্লাবনে ভেসে যাচ্ছিলেন আখতার আহমেদ রাশা। কিন্তু একটা মানুষও বুঝতে পারলেন না রাশা সাহেব শিল্পকর্মের নামে পুরোদস্তুর চৌর্যবৃত্তি করেছেন। তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর অনন্যসাধারণ ভাস্কর্যশিল্পকে টপ টু বটম নকল করেছেন। তিনি প্রিয়দর্শিনীর শিল্পকর্ম থেকে ইনস্পায়ার্ড হতে পারতেন। যে কেউ যেকোনো বিষয়ে অনুপ্রাণিত হতে পারে, সেটা দোষের নয়। কিন্তু রাশা সাহেব যেটা করেছেন এটা গর্হিত অপরাধ। চৌর্যবৃত্তির খড়গ থেকে তার কি নিস্তার পাওয়ার উপায় আছে? বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মননশীলতাকে রাশা সাহেব রীতিমতো ডাকাতি করেছেন। উনি অনুপ্রাণিত হয়ে একটি দুটি শিল্পকর্ম যদি বানাতেন তাও মানা যেত। কিন্তু একি? সবগুলোই কি রাশা সাহেবকে নকল করতে হবে? প্রিয়ভাষিণীর অসাধারণ শিল্পকর্মকে নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার হীন মনোবৃত্তিকে সমর্থন দিতে পারলাম না। নিউইয়র্ক কম্যুনিটিতে বহু স্বঘোষিত কবি লেখক ও সচেতন মানুষ আছেন। আমি আশ্চর্য হলাম, এদের একজনও একটা বিবৃতি /বক্তব্য দিলেন না। কেন দিলেন না? এদের অনেকেই গা বাঁচিয়ে চলে। নিজের নৈতিক অবস্থান থেকে সঠিক মন্তব্য করার যোগ্যতা এরা হারিয়ে ফেলেছেন। হয়তবা তারা সেই যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। স্বঘোষিত কবি লেখক অথবা কম্যুনিটির ধামাধরা ব্যক্তিত্ব হলে কি হবে? নিজের বিবেককে এরা সবসময় চেতনানাশক ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
আখতার আহমেদ রাশা ট্যালেন্টেড পার্সন। কিন্তু চৌর্যবৃত্তির চিন্তাভাবনা তার মাথায় কিভাবে এলো সেটাই আমার প্রশ্ন। প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর্য শিল্পের উপর লুঠতরাজ চালিয়ে গেছেন। তার উচিত ছিল প্রিয়ভাষিণীর কন্যা ফুলেশ্বরী প্রিয়দর্শিনীর কাছ পারমিশন নেয়া। কিন্তু সেটা না করে রাশা সাহেব নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলেন। আপনি লাগাতার আরেকজনের শিল্পকর্মের অরুচিকরভাবে নকল করবেন আর সস্তা বেহুদা হাততালি বাহবা কুড়াবেন, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো রাশা ভাই, “আপনার বিবেক কি আপনাকে ধিক্কার দিচ্ছেনা? কাউকে নকল না করে/কপি না করেও নিজের থট ইউজ করে আপনি রুচিশীল ভাস্কর শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেতে পারতেন । আপনার মৌলিক কাজ নিয়ে তুষ্ট থাকতে পারতেন। প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর্য নকল করে রাশা আহমেদ বেশ অসুবিধায় পড়বেন বলে মনে হচ্ছে। নিজে ভাস্কর্য হুবহু নকল করে মুলতঃ উনি ক্রাইম করেছেন।
আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক শ্রদ্ধেয় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী একখন্ড রক্তিম আবেগের নাম। বুক বিদীর্ণ করা দু’ফোঁটা চোখের জলের নাম। গর্বে বুকের ছাতি ফুলানো একটা স্ফুলিঙ্গের নাম। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু সৈনিক ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী গোটা বাংলাদেশের লৌহমানবী। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে বুকের সব ঘৃণা উগলে দিয়েছেন এবং রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এই লড়াকু সৈনিক প্রিয়ভাষিণী। তাঁর মর্মভেদী ইতিহাস আমরা যারা জানি রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়। এই মানুষটার উপর নৃশংসতা বীভৎসতার স্টীম রোলার চালিয়েছে পাকিস্তানি হানাদাররা। একাত্তর সালে ক্রিসেন্ট জুট মিলে চাকরি করতেন। কিন্তু সেটা পাকি দখলদাররা নিজেদের কব্জায় নিয়ে যায়। সেই সাথে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীও পাকসেনাদের কব্জায় ছিলেন। পাকসেনা, নেভাল কমান্ডার, অফিসের পিতৃতুল্য, ভ্রাতৃতুল্য বড়কর্তা থেকে শুরু করে গাড়িচালক, অবাঙালি, মিলিশিয়া, রাজাকার – চারদিকে মানুষের বদলে কেবল ধর্ষকের নাগপাশ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজেছেন প্রিয়দর্শিনী। টেলিফোন অপারেটর প্রিয়ভাষিণীকে কখনো স্বীয় কর্মস্থলে কখনো যশোর ক্যান্টনমেন্টে অথবা তাদের ইচ্ছেমতো জায়গায় হতে হয়েছে পাশবিক নির্যাতনের শিকার। তাঁর হাতের আঙুল মটকে দিয়েছে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে গুপ্তাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে দেয়া হয়। আমার মা’কে দেখতাম প্রিয়ভাষিণীকে নিয়ে যেকোনো লেখা দেখলেই অঝোরে কাঁদতেন।
এই মানুষটা লক্ষ লক্ষ বাঙালির হৃদয়ের আসনে শ্রদ্ধার সঙ্গে আসীন হয়ে আছেন।। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী একজন ভাস্কর্য শিল্পী। স্বমহিমায় তিনি ভাস্কর তৈরি করে গেছেন। প্রিয়ভাষিণী তাঁর শৈল্পিক চিন্তাভাবনা ও মননের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তাঁর ভাস্কর্যে। এক একটা ভাস্কর্য যেন এক একটা ইতিহাস।
মধ্যরাতে মিলের কোয়ার্টার থেকে তার লম্বা চুলের মুঠি ধরে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে জিপে তোলা হয়। মটকে দেওয়া হয় হাতের আঙুল। বেয়নেটের আঘাতে যোনিপথে রয়ে যায় চিরস্থায়ী ক্ষত। শরীর জুড়ে অচেনা, অবাঞ্ছিত নখের আঁচড়, সোনালি দাঁতের বিষাক্ত দংশন। ক্ষতবিক্ষত স্তনের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে তুলা গুঁজে ব্যথা চেপে সকালবেলা টেলিফোন (পিএবিএক্স) বোর্ডে বসতে হতো তাকে।
বিপদসংকুল সময়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফোনে আড়ি পেতে তথ্য সংগ্রহ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। নিজের দেহে শত্রুর ভ্রূণের উপস্থিতি টের পেয়ে গোপনে টাকা জোগাড় করে ধ্বংস করেছিলেন প্রিয়ভাষিণী। তাকে খুলনা থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট নেয়ার পথে আর্মিদের জিপে গণধর্ষণ করা হয়েছিল–এসব যখন পড়েছি নরাধমদের প্রতি ঘৃণায় কুঁকড়ে গেছি।
আমাদের স্বাধীনতা এত সহজে অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশের মানচিত্র নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য পাক হানাদার ও দেশীয় রাজাকার শকুনদের স্বাধীনতা বিরোধী কার্যকলাপের ভেস্তে দিতে গিয়ে মা বোনেরা তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। আজও স্বাধীন বাংলাদেশে শকুনের প্রজন্মকে বিশেষ ট্রেইন্ড করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে। শ্রদ্ধেয় ভাস্কর বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর চোখ ধাঁধানো শিল্পকর্ম বাংলাদেশের আনাচে কানাচে পৌঁছে গেছে। আখতার আহমেদ রাশা কেমন বিবেচনায় এতবড় জঘন্য কাজটা করতে পারলেন?? উনার বিবেক কি একটুও অস্বস্তিতে ফেলেনি উনাকে?
আপনি প্রিয়ভাষিণীকে ভীষণ শ্রদ্ধা করেন, সেটা আপনার এমন অস্বচ্ছ আচরণে প্রকাশ পায়নি। প্রিয়ভাষিণীকে আইডল মেনে আপনি উনার সৃষ্টিকর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ভাস্কর্য বানিয়েছেন। কিন্তু হুবহু উনার ভাস্কর্য নকল করবেন কেন? রাশা সাহেব আইডিয়া নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি চরম চৌর্যবৃত্তির পরিচয় দিয়েছেন। প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্মকে চুরি করে একক ক্রেডিট নিতে গিয়েছেন। কিন্তু ধরা খেয়েছেন বাজে ভাবে। নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কম্যুনিটির বড় বড় মোটা মাথাগুলো এই বিষয়ে মৌনব্রত পালন করছেন। ছোট্ট কয়টা লাইনে প্রতিবাদ করার মত ক্যাপাসিটিও তারা হারিয়ে ফেলেছেন। এসব অন্ধ বধির অক্ষমরা একটাই ভালো জানে, নারীদের শাড়ির আঁচল গানবাজনা ও সাহিত্যের নামে আড্ডা। প্রতিবন্ধীরা নাচগানের জলসা আর ফটোসেশনের ইভেন্ট এরা মিস করেনা। আখতার আহমেদ রাশা সাহেবকে তার অপরাধের জন্য তীব্র জানাচ্ছি।