Tuesday , January 7 2025
Breaking News
Home / Countrywide / ভ্যাট বাড়য় চাপ বাড়বে ভোক্তার, মানতে নারাজ অর্থ উপদেষ্টা

ভ্যাট বাড়য় চাপ বাড়বে ভোক্তার, মানতে নারাজ অর্থ উপদেষ্টা

সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর চাপের কারণে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক আইনে কিছু সংশোধন আনার পরিকল্পনা করছে। এর ফলে ১৫% ভ্যাট ও শুল্ক তিন ডজনেরও বেশি পণ্যে আরোপ হতে পারে, যার মধ্যে বিস্কুট, আচার, কয়েল, টিস্যু পেপারসহ বিভিন্ন পণ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর ফলে বাজেট ঘোষণার আগেই এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এসব তথ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে।

গণপ্রতিষ্ঠান ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভ্যাট বাড়ানো হলেও এর প্রভাব পণ্যের দামগুলোতে খুব বেশি পড়বে না।

এদিকে, ব্যবসায়ী মহলে ভ্যাট বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে এবং তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, প্রয়োজন হলে তারা সড়কে নেমে প্রতিবাদ জানাবে।

সূত্র জানায়, ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক আইনে সংশোধন আনার প্রস্তাব, যার মধ্যে ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ কমিটির পরামর্শ সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলে এই প্রস্তাবটি শনিবার অধ্যাদেশ আকারে জারি হতে পারে।

এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংসদে অনুমোদন ছাড়াই কর বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়, এজন্য রাষ্ট্রপতির আদেশে অধ্যাদেশ জারি হচ্ছে। এছাড়া, আগামী অর্থবছরের শুরু থেকে এনবিআর প্রায় সমস্ত পণ্য ও সেবায় ১৫% ভ্যাট একীভূতভাবে আরোপ করতে চায়।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ভ্যাট বৃদ্ধির এই উদ্যোগ মূলত আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য নেওয়া হচ্ছে। তারা বলছেন, সরকারের আরো রাজস্ব প্রয়োজন এবং বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় ভ্যাট এবং শুল্ক বাড়ানোর মাধ্যমে সেই রাজস্ব অর্জন করা হবে। এতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর আর্থিক চাপ বাড়বে, তবে সাধারণ নাগরিকদের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, আইএমএফ সরকারকে কর ছাড় কমানোর এবং রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য পরামর্শ দিয়েছে, বিশেষ করে ভ্যাটের হার গুলি যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এর সাথে সম্পর্কিত আলোচনা গত বছর আইএমএফের সঙ্গে এনবিআরের হয়েছিল।

যেসব পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি হতে পারে সেগুলোর মধ্যে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, দুধের গুঁড়া, বিস্কুট, আচার, টমেটো সস, সিগারেট, জুস, টিস্যু পেপার, ফল, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, স্যান্ডেল, এবং বিমানের টিকিট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এমনকি মোবাইল ফোন কল, ইন্টারনেট ব্যবহার, এবং হোটেল ও রেস্টুরেন্টে খাবারের খরচেও ভ্যাট বাড়ানো হতে পারে। এসব পণ্যের ভ্যাট বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বাড়াতে পারে এবং মুদ্রাস্ফীতির হার আরও বাড়তে পারে।

সূত্র জানাচ্ছে, আইএমএফ সরকারের কাছ থেকে কর-জিডিপি অনুপাত ০.২% বাড়ানোর শর্ত রেখেছে, যা ১২,০০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। এটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্য ৪,৮০,০০০ কোটি টাকার মধ্যে যুক্ত হবে।

রাজস্ব ঘাটতি পূরণের জন্য বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট মাসে রাজনৈতিক আন্দোলন এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক চ্যালেঞ্জের কারণে, এনবিআরের আর কোনো বিকল্প নেই, তাই ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

রেস্টুরেন্ট খাতে ১৫% ভ্যাট খাবারের বিলের ওপর আরোপ করা হবে, যা আগে এসি রেস্টুরেন্টে ৫% ছিল। এছাড়া, প্রস্তুতকৃত পোশাক এবং মিষ্টির ওপর ভ্যাট ৭.৫% থেকে ১৫% বাড়ানো হতে পারে।

নন-এসি হোটেল এবং অন্যান্য সেবা সম্পর্কিত পণ্যের ভ্যাট হারের পরিবর্তনও হতে পারে, যার মধ্যে ফল, বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, গদি, এবং টিস্যু পেপার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কর্তৃক চালান দেয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের ওপরও ১৫% ভ্যাট আরোপ করা হতে পারে। এছাড়া, মদ্যপান সামগ্রীর সম্পূরক শুল্ক ২০% থেকে ৩০% বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রস্তাব রয়েছে, এমন ব্যবসার ওপর টার্নওভার ট্যাক্স আরোপ করা হবে যাদের বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ টাকার বেশি। বর্তমানে ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকার লেনদেন করা ব্যবসাগুলো এই করের আওতায় আসে, তবে নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী বার্ষিক ৫০ লাখ টাকার বেশি লেনদেন করা ব্যবসাগুলোকে কর দিতে হবে।

আমদানী, উৎপাদন, এবং সেবা পর্যায়ে কয়েকটি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি হতে পারে, যেমন ফলের রস (২০% থেকে ৩০%), তামাক (৬০% থেকে ১০০%), এবং সুপারি (৩০% থেকে ৪৫%)। এছাড়া, মোবাইল ফোন টকটাইমের উপরও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হতে পারে।

যাতায়াত সংক্রান্ত করের মধ্যে বিমানযাত্রায় এক্সাইজ ডিউটি বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। দেশীয় বিমানযাত্রার এক্সাইজ ডিউটি ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা বাড়ানো হতে পারে, এবং আন্তর্জাতিক যাত্রার ক্ষেত্রে এক্সাইজ ডিউটি ৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে, গন্তব্য অনুসারে।

অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, যদিও বেশ কিছু খাতে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে, তবে এর প্রভাব খুব বেশি পড়বে না কারণ প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো শুল্কমুক্ত থাকবে। তিনি আরও বলেন, কিছু পণ্যের দাম বাড়লেও মুদ্রাস্ফীতির উপর তেমন প্রভাব পড়বে না। বিমান টিকিটের ভ্যাট বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে, যারা দেশীয় যাতায়াত করবেন, তারা ২০০ টাকার দাম বাড়ানোর কারণে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ভ্যাট বাড়ানোর বিষয়ে যথাযথ গবেষণা ও বিশ্লেষণ না করে এটি বাস্তবায়ন করা অর্থনীতি জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। পলিসি এক্সচেঞ্জের নির্বাহী পরিচালক ড. মাশরুর রিয়াজ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, এনবিআর চালের দাম, তেল, চিনি ইত্যাদির দাম নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যদিও শুল্ক কমানো হয়েছিল। সুতরাং, যথাযথ বিশ্লেষণ ছাড়া ভ্যাট বাড়ানো মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে পারে এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।

ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া: ব্যবসায়ী মহল ভ্যাট এবং শুল্ক বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কঠোর বিরোধিতা করেছে। তারা বলছে, জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থগিত ছিল, তবে এখন ভ্যাট বৃদ্ধি করার ফলে সরকার নিজেরই ক্ষতি করছে। বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেছেন, ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে বিশেষত ছোট ব্যবসায়ীদের ওপর অযথা চাপ আসবে। তিনি সতর্ক করেছেন যে, সরকার যদি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে, তাহলে তারা সকল রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। পর্যটন খাতের একজন উদ্যোক্তা বলেছেন, পর্যটন শিল্প ইতিমধ্যে সমস্যায় রয়েছে এবং বিমান টিকিটের দাম বাড়ানো হলে তা আরও ক্ষতির কারণ হবে। তারা জানিয়েছে, তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে অন্যান্যদের সাথে বৈঠক করবেন।

About Nasimul Islam

Check Also

অবশেষে নিজের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ নিয়ে মুখ খুললেন টিউলিপ

দুর্নীতির অভিযোগে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে অবশেষে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন ব্রিটিশ লেবার পার্টির মন্ত্রী ও বাংলাদেশের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *