বিশ্বের অসংখ্য দেশে বর্তমান সময়ে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী বসবাস করছে। এবং এই সকল প্রবাসীদের থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুল পরিমানের রেমিট্যান্স অর্জন করছে। তবে এই খাত থেকে আয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন রপ্তানি পন্য থেকে ও আয় করছে বাংলাদেশ। অবশ্যে তুলনামূলক ভাবে রপ্তানি পন্যের আয়ের পরিমান বেশি থাকা স্বত্তেও বাংলাদেশ এই খাতকে কাজে লাগাতে পারছে না। ইউরোপের দেশ গুলোতে বেশি পন্য রপ্তানি করছে। মধ্যেপ্যাচ্যের অনেক দেশে এখনও বাজার ধরতে পারেনি বাংলাদেশ। এই বিষয়ে নতুন চিন্তা ভাবনায় রয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিতে মধ্যপ্রাচ্য প্রধান গন্তব্য হলেও পণ্য রপ্তানিতে পিছিয়ে আছে হাতের কাছের এই বাজারটি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্সের ৫৫ শতাংশ উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলো থেকে এলেও মাত্র ৩ শতাংশ রপ্তানি আয় আসে ওই অঞ্চল থেকে।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১ হাজার কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে, সেখানে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে মাত্র ৩৬ কোটি ডলার বা ৩ হাজার কোটি টাকার পোশাক। সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাধীনতার পর থেকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে মূলত দুটি চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে- যার একটি হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি আর পেট্রোডলারের দেশ থেকে বড় বিনিয়োগ আনা। কিন্তু এই দুটি সম্ভাবনার পাশাপাশি উপসাগরীয় অঞ্চল যে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির বড় বাজার হতে পারে সে বিষয়ে কেউ ভাবেনি। এমন কি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মধ্যেও ইউরোপ-আমেরিকার বাজার নিয়ে যতটা আগ্রহী মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ততটা দেখা যায়নি। সরকারি সূত্রগুলো জানায়, দেশের গার্মেন্ট উদ্যোক্তারা মূলত আমেরিকা-ইউরোপের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে পোশাক তৈরি করেন। ফলে পশ্চিমের বাজারই এখনো দেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য। কিন্তু হাতের কাছেও যে মধ্যপ্রাচ্যের মতো সম্ভাবনাময় বাজার আছে, সে বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো উদ্ভাবনীমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি সরকার কিংবা বেসরকারি খাতের কেউ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরব দেশের মানুষ সাধারণত যে ধরনের জোব্বা, আলখেল্লাজাতীয় ঢিলেঢালা পোশাক পছন্দ করেন, সে ধরনের পোশাক তৈরির মতো গার্মেন্ট কারখানা দেশে নেই বললেই চলে। আরব ফ্যাশন নিয়েও তেমন কোনো গবেষণা নেই উদ্যোক্তাদের। সূত্র জানায়, শুধু তৈরি পোশাক নয়, ওষুধ থেকে শুরু করে কৃষি ও খাদ্যজাত পণ্য রপ্তানির সব ধরনের সম্ভাবনা থাকার পরও ভুল বাণিজ্য নীতির কারণেই মূলত মধ্যপ্রাচ্যে দেশের পণ্য রপ্তানি বাড়ছে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশে উৎপাদিত রাসায়নিকমুক্ত নিরাপদ শাক-সবজি ও হালাল খাদ্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। একই রকম চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশের ওষুধ খাদ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্যের। তবে সঠিক সময়ে নীতিগত কৌশল গ্রহণ করতে না পারা, হালাল পণ্যের সার্টিফিকেশন দিতে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করতে না পারার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশ হালাল পণ্যের বাজার ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি বেসরকারি খাতের সঙ্গে যৌথভাবে ঢাকায় সপ্তাহব্যাপী ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সামিটের আয়োজন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানেও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে হতাশাজনক তথ্য ওঠে আসে। ওই সামিটে ‘মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক সহযোগিতা’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি এখনো আশানুরূপ নয়। রপ্তানি আশানুরূপ না হওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশে উৎপাদিত তৈরি পোশাক খাতের বহুমুখীকরণের অভাব, অদক্ষ মানবসম্পদ, হালাল পণ্য রপ্তানিতে প্রয়োজনীয় সনদ ও টেস্টিং ল্যাবরেটরির অনুপস্থিতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি-এফটিএ ও পিটিএর অভাবকে তুলে ধরেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সম্প্রতি বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের কৌশল হিসেবে আমরা ইউরোপ-আমেরিকার পর এবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি সম্প্রসারণে গুরুত্ব দিচ্ছি। সম্প্রতি আরব আমিরাতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে জয়েন্ট কমিশনের বৈঠক হয়েছে সেখানে ১৬২টি পণ্যের শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা চাওয়া হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষে। বাণিজ্যের কর্মকর্তারা জানান, উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক জোট ‘গলফ ইকোনমিক কাউন্সিলভুক্ত দেশ বা জেসিসিতে আছে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন ও সৌদি আরব। জেসিসিভুক্ত দেশগুলোতে পোশাক পণ্য রপ্তানির বড় বাজার রয়েছে। আছে ওষুধসহ কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বিপুল চাহিদা। বর্তমানে হালাল পণ্যের বড় বাজার গড়ে ওঠেছে সেখানে। কিন্তু জেসিসির কাস্টমস ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো চুক্তি না থাকায় মধ্যপ্রাচ্যে কোনো বাজার সুবিধা মিলছে না। সরকার মনে করছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত জেসিসির অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। সেখানে শুল্ক সুবিধা পাওয়া গেলে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতেও বাজার সুবিধার পথ খুলে যাবে।
দেশের অর্থনীতির গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইউরোপের দেশের পাশাপাশি মধ্যপ্যাচ্যের সকল দেশ গুলোতে রপ্তানি প্রসার বৃদ্ধি জরুরি। তাহলে আয়ের পরিমানও বৃদ্ধি পাবে। এবং বাংলাদেশ ক্রমশই উন্নয়নের দিকে খুব সহজেই ধাবিত হতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের অনেক পন্যেরই বিশেষ চাহিদা রয়েছে বিশ্বের অনেক দেশেই।