সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী অংশগ্রহন করছে। তবে এই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে দেশ জুড়ে আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে রয়েছেন আওয়ামীলীগ দলের মনোনীত সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকার। ইতিমধ্যে তারা দিজেনই তাদের প্রচার প্রচারনা শুরু করেছেন। সম্প্রতি নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রেক্ষাপটসহ রাজনৈতিক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথোপকথন হলো তৈমুর আলম খন্দকারের সঙ্গে। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো বিস্তারিত।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকার এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কারণ কী আপনার?
তৈমুর আলম খন্দকার: আমি ২০০২ সাল থেকেই চেষ্টা করছিলাম এ পৌরসভা সিটি করপোরেশন হোক। আমার প্রস্তাবের ভিত্তিতেই ২০০২ সালের ২৬ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন হয়। পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন করার একটি কারণ হলো, নাগরিক সুবিধা বাড়ানো। কিন্তু এখন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের যে প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা, এর নিরসন হয়নি। আধা ঘণ্টা বৃষ্টি হলে বঙ্গবন্ধু সড়ক পানির তলে চলে যায়। পেশাজীবী খেটেখাওয়া মানুষের সুযোগ এবং অধিকার, কোনোটাই নেই। ভলভো বাস আনার জন্য আমি সুইডেনে গিয়েছিলাম। সেখানেও দেখেছি, হকার আছে। আমার কথা হলো, হকারও থাকতে হবে, আবার জনগণও রাস্তা দিয়ে ভালোভাবে হাঁটবে। এখন হকাররা নারায়ণগঞ্জে বসে পু/লি/শ/কে পয়সা দিয়ে। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি।
এ অভিযোগ তো সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীও করেন যে হকারদের বসানোর পেছনে মূল বিষয় চাঁদাবাজি।
তৈমুর আলম খন্দকার: সে যা–ই হোক। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নারায়ণগঞ্জে চোর-পু/লি/শের খেলা চলছে। আরেকটা খেলা চলছে আলাল-দুলালের খেলা। আলাল যদি ডানে যায়, দুলাল যায় বাঁয়ে। আলাল যদি বাঁয়ে যায়, দুলাল যায় ডানে। সাংসদ শামীম ওসমান যদি ডানে যায়, মেয়র আইভী যায় বাঁয়ে। মেয়র ও সাংসদের মধ্যে বিরোধ থাকতে পারে। মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে, দুজনেরই অধিক্ষেত্র জনগণ। জনস্বার্থে তাঁরা দুজন একসঙ্গে বসতে পারবেন না কেন? তাঁরা একই দল করেন। তাঁদের বিরোধের ভুক্তভোগী হই আমরা, জনগণ। টক শোতে দুজন গিয়ে যে ভাষা ব্যবহার করলেন, সেখানে কী বোঝা যায় যে নারায়ণগঞ্জের সব মানুষ এসব ভাষা ব্যবহার করে? এখন মেয়র ও এমপির বিরোধের কারণে নগরের মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে। আমি যদি নির্বাচিত হই, আমি সবার সঙ্গে বসব। এমপি, প্রশাসন সবার সঙ্গে বসে জনগণের সমস্যার সমাধান করব। আবার আমার রাজনৈতিক আদর্শেও অটুট থাকব। যেখানে বিরোধিতা করার দরকার, রাজনৈতিকভাবেই এর বিরোধিতা করব। কিন্তু উন্নয়নের প্রশ্নে জনগণের স্বার্থেই থাকব।
তাহলে সাংসদ শামীম ও মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে ভোগান্তি দূর এবং নাগরিক পরিষেবা বাড়ানোই আপনার লক্ষ্য?
তৈমুর আলম খন্দকার: আরও বিষয় আছে। নারায়ণগঞ্জে কর বাড়ানো হচ্ছে। সব জায়গায় কর আছে। ছেলে-মেয়েরা প্রেম করতে গেলেও কর দিতে হয়। যেমন তারা প্রেম করতে মুঠোফোনে কথা বলতে গেলে কর দিতে হয়। এভাবে জনগণ তো কর দিচ্ছেই। কিন্তু এর বিনিমিয়ে তো নাগরিক সুবিধা দিতে হবে। এর জন্য সরকার ভর্তুকি দেবে। সরকারের কাছে থেকে তা আদায় করতে হবে সিটি করপোরেশনকেই। আর নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর জন্য ১০০ বছরের মাস্টার প্ল্যান দরকার। সকালে কাজ করলাম বিকেলে ভেঙে ফেললাম—এমনটা করলে হবে না। আমি যদি মেয়র হই, তবে ১০০ বছর সামনে রেখে আমি একটি মাস্টারপ্ল্যান করব। এটা জনগণের কাছে ছেড়ে দেব। তাদের পরামর্শের ভিত্তিতেই এর বাস্তবায়ন হবে।
মেয়র নির্বাচন তো একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। আপনি বিএনপির মতো একটি বড় দলের সঙ্গে আছেন। বিএনপি নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তাহলে আপনি সেই দলের সমর্থন কীভাবে বা কতটুকু পাবেন?
তৈমুর আলম খন্দকার: জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তো আলাদা। নারায়ণগঞ্জে এসে দেখেন, আমার দলের লোকজন আমার সঙ্গে কতটুকু আছে। আমার ডানে-বাঁয়ে কে বা কারা আছে, দেখেন। সামনে ও পেছনে কে, দেখেন।
দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও তো সমর্থন আছে?
তৈমুর আলম খন্দকার: এটা না থাকলে কী আমি রাজনীতি চালিয়ে নির্বাচন করতে পারছি? দলীয়ভাবে সমর্থন দেওয়ার প্রশ্ন অন্য। নারায়ণগঞ্জ তো বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ না।
মেয়রের পদে তো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়। সেই প্রতীক তো আপনি পেলেন না। প্রতীকেরও তো একটা গুরুত্ব থাকে।
তৈমুর আলম খন্দকার: ম্যাডামের এমন অসুস্থতার সময় কীভাবে আমি বলব যে আমাকে প্রতীক দেন? আমি কী বলতে পারি।
দলীয় প্রধানের অসুস্থতা যদি প্রতীক না নেওয়ার কারণ হয়, তাহলে নির্বাচন করা কেন?
তৈমুর আলম খন্দকার: নির্বাচন করছি জনগণের স্বার্থে। নারায়ণগঞ্জের সমস্যা আপনি বুঝবেন না। এ দেশে নির্বাচন আগের রাতে হয়ে যায়। সরকারি আমলা ও পুলিশ নির্বাচন করে দেয়। তবে এটা মনে রাখেন, একেক সময় একেকটা মৌসুম আসে। আমের সময় আম, জামের সময় জাম। এখন মৌসুম স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। স্বতন্ত্র হওয়াতে আমি আওয়ামী লীগসহ সব দলের লোকের সমর্থন পাচ্ছি।
একটু আগে যে আলাল-দুলালের কথা বললেন, তাহলে মেয়র আইভীর বিরোধীরা কী আপনাকে ভোট দেবে, তাঁদের এই অন্তর্দ্বন্দ্বের সুবিধা আপনি পাবেন?
তৈমুর আলম খন্দকার: আমাকে সব দলের লোক ভোট দেবে। এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকেন।
গতবার নির্বাচনের ঠিক আগে দলের সিদ্ধান্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেন। পরে বললেন, কো/র/বানি হয়ে গেলাম। এবারও এমন হবে না তো? গতবারের কথা মনে রেখে মানুষ তো আপনার প্রতি আস্থা নাও রাখতে পারে। আপনি বলছেন, সরাসরি মনোনয়ন না পেলেও দলের সমর্থন আছে।
তৈমুর আলম খন্দকার: এবার তো আমি দলের মনোনীত না। গতবার আমি দলের মনোনীত ছিলাম। আমার দায়দায়িত্ব ছিল দলের প্রতি। এবার জনগণের মাধ্যমে মনোনীত হয়েছি। আর গতবারের ঘটনার পর আস্থা কমে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং মানুষ আমার দলের প্রতি আমার আনুগত্যকে সম্মান করবে। সেবার কুমিল্লা নির্বাচনও ছিল। সেখানে মনিরুল হক সাক্কুকে বলা হয়েছিল প্রত্যাহার করতে, তিনি করেননি। আমি করেছিলাম। সাক্কু জিতেছিলেন। আমিও সেই সময় জিততে পারতাম। কিন্তু আমার ত্যাগের মাধ্যমে দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলাম। দলীয় নেতা-কর্মীরা এটাকে মনে রেখেছে।
তার মানে স্থানীয় মানুষের সমর্থন এবং সেই সঙ্গে দলেরও নীরব সমর্থন, দুটোই আপনার সঙ্গে আছে?
তৈমুর আলম খন্দকার: আমার কর্মতেই দেখবেন। দলের কেন্দ্রীয় কোনো নেতা বা মহাসচিব কেউ তো বলেননি যে আমাকে তাঁরা সমর্থন দেননি। বা তাঁরা দলের কাউকে বলেননি যে তৈমুর আলমের নির্বাচন করো না। বরং প্রেসক্লাবে ফখরুল সাহেব প্রকারান্তরে সমর্থন করেছেন। আমার কথা হলো, একটি রাজনৈতিক দলকে বিভিন্ন কৌশলের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়। আমরা সেই কৌশল নিয়েই এগোচ্ছি।
অনেক সময় দেখা গেছে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করলে তো বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে, এ ক্ষেত্রে এমন হবে না নিশ্চয়ই।
তৈমুর আলম খন্দকার: হলে তো এত দিনে হয়ে যেত।
বিএনপি মুখে বলছে নির্বাচন করছি না, আবার প্রার্থীকে সমর্থনও দিয়ে যাচ্ছে। এই দ্বিমুখী আচরণের সমালোচনা করেন অনেকে।
তৈমুর আলম খন্দকার: এটা কোনো দ্বিমুখী আচরণ না। রাজনীতিতে সব জায়গায় কৌশল অবলম্বন করা হয়। বিএনপিকে এখন অনেক হিসাব-নিকাশ করে চলতে হচ্ছে।
জয়ের ব্যাপারে কতটুকু আশাবাদী। সিটি মেয়র আইভী তো অনেক জনপ্রিয়।
তৈমুর আলম খন্দকার: সেটা ১৬ জানুয়ারি বোঝা যাবে। আমি নারায়ণগঞ্জে কোনো গণবিরোধী ভূমিকা নিইনি। নারায়ণগঞ্জের মানুষ আমাকে মজলুম জননেতা বলে। তাদের প্রতি আমার দায়দায়িত্ব আছে। আমি কোনো মসজিদ বা মন্দিরের জায়গা দখল করিনি। কারও গাছ থেকে কাঁচা মরিচ ছিঁড়ে এনেছি—এমন রেকর্ড নেই।
দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামীলীগ দল। এবং এই দলটি দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকায় পদ-পদবি নিয়ে প্রায় সময় একে অন্যের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে এই দলের নেতাক্রমীরা। এমনকি এই দলের অনেক নেতাকর্মী দলের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে এবং নানা ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।