পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সাধারণ পরিষদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আনুষ্ঠানিক ভাষ্য উপস্থাপন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জরুরি নির্দেশনা পেয়ে সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা’য় এক কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে তা তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ওই গুরুত্বপূর্ণ ব্রিফিংয়ে ঢাকায় অবস্থিত বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের প্রায় অর্ধশতাধিক প্রধান (রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স), জাতিসংঘের অধীনে বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ব্রিফিংয়ে তিনটি বিষয় তুলে ধরা হয়।
এক. অতীতের ধারাবাহিকতায় গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি ‘নাশকতামূলক’ তৎপরতা চালায়। ঘটনাস্থলে এক পুলিশ সদস্য নিহ”তসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর অসংখ্য হা”মলার ঘটনা ঘটেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ না করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ধৈর্য ধরে কিছু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।
দুই. বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকারের অবস্থান মেনে নিতে চাইলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে বিএনপি। এর বাইরে কিছু ভাবলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।
তিন. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের মাঝে মাঝে বক্তব্য নয়, কোনো বক্তব্য থাকলে প্রথমে ভিয়েনা কনভেনশনের আলোকে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।
এর বাইরে কোনো বিষয়ে দূতাবাসের (আগবরদা) কোনো বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হবে না।
সূত্র জানায়, ২৮শে অক্টোবরের সব ঘটনার দায় একতরফাভাবে বিএনপি’র ঘাড়ে চাপানো, আসন্ন নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের অনড় অবস্থান এবং সর্বশেষ বিদেশিদের বক্তব্য-বিবৃতি প্রদানে নিরুৎসাহিত করার বয়ান শুনে ব্রিফিংয়ের প্রায় পুরোটা সময় নীরব ছিলেন কূটনীতিকরা। নির্বাচন এবং বিবৃতি দিতে বিদেশীদের সর্বশেষ নিরুৎসাহিত করা. বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র বা উন্নয়ন সংস্থার কোনো প্রতিনিধি, নিকটে বা দূর, পূর্ব বা পশ্চিমে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। ব্রিফিং শেষে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী-উপদেষ্টার যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ‘কূটনীতিকদের নীরবতা’ নিয়ে প্রশ্ন অব্যাহত রয়েছে। জবাবে তারা প্রায় অভিন্ন ভাষায় বলেন, সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার পর আমন্ত্রিত কূটনীতিকদের প্রশ্ন করা হয়েছে। তাদের মতামত জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করেনি বা কোনো মন্তব্য করেনি। তারা শুধু শুনেছেন।
কূটনীতিকরা সরকারের ব্রিফিংয়ে সন্তুষ্ট কিনা জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ কে আবদুল মোমেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তারা সন্তুষ্ট হয়েছেন, কি হননি সেটা তাদেরই জিজ্ঞেস করুন। এ বিষয়ে সম্পূরক প্রশ্নে আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক বলেন, আমরা কিন্তু বলিনি যে, সাইলেন্স (নীরবতা) মানে সম্পূর্ণ এগ্রি (একমত পোষণ) করেছেন। আবার আমরা এটাও বলছি না যে, তারা ডিজএগ্রি (ভিন্নমত পোষণ) করেছেন। আমরা বলছি উনাদের প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল, উনারা কোনো প্রশ্ন করেননি। তার মানে আমরা যতটুকু বুঝতে পারি, আমরা যে ব্যাখ্যা দিয়েছি সেটা অন্তত তাদের কাছে পরিস্কার হয়েছে। উনারা কনভিন্সড কি কনভিন্সড নন সেটা বলার দায়িত্ব আমাদের না। সেটা তারাই বলতে পারবেন।
কূটনীতিকরা প্রশ্ন করেননি উল্লেখ করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম বলেন, এখানে সব রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা ছিলেন। তারা সবাই চুপ হয়ে ছিলেন। তারা আমাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। কারণ তাদের কেউ কিছু বলেননি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ২৮ অক্টোবরের ঘটনাগুলোর ফুটেজ বিদেশি মিশনে পাঠানো হয়েছে। আজ আবার তাদের সহিংসতার ভিডিও ফুটেজসহ বিভিন্ন নথি দেখানো হয়েছে। বিদেশি কূটনীতিকদের বক্তব্য কী জানতে চাইলে শাহরিয়ার আলম বলেন, তাদের অভিব্যক্তি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে তারা এসব দেখে হতবাক। ব্রিফিংয়ের সূচনা বক্তব্যে আবদুল মোমেন বলেন, ২৮ অক্টোবর যা ঘটেছে তাতে আমরা হতবাক। তবে অতীতে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার অভিজ্ঞতায় আমরা খুব বেশি অবাক হইনি। দুঃখের সাথে বলতে হয়, আমরা তাদের পরিবর্তন আশা করেছিলাম, কিন্তু তারা তা করেনি।
ব্রিফিং শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রার নামে বিএনপি যে সহিংসতা করেছে আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই এবং তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা দরকার। গত কয়েকদিনে তারা যা করেছে, তার মূল উদ্দেশ্য নির্বাচন যেন অবাধ ও সুষ্ঠু না হয়। নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য তারা এ ধরনের অপকর্ম করেছে। আমরা সেজন্য বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের ডেকেছি। তাদের বলেছি, ২৮ তারিখে এখানে কী হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মিথ্যা উপদেষ্টা হিসেবে একজনকে নিয়ে কী কী করা হয়েছে, সেটাও তুলে ধরেছি।”
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যমুনা ব্রিফিংয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি কূটনৈতিক মিশন, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছে ২০ পৃষ্ঠার একটি অফিসিয়াল ভাষ্য হস্তান্তর করা হয়েছে। ‘ছবিতে বিএনপির বর্বরতা’ শিরোনামের উপস্থাপনায় ২৮ ও ২৯ অক্টোবর বিএনপির গণসভা ও হরতাল চলাকালীন সহিংসতার ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে। ব্রিফিংয়ে উপস্থিত বেশ কয়েকজন কূটনীতিক আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করে তারা বলেন, ২৮ অক্টোবর ও পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে সরকারের বক্তব্য তারা শুধু শুনতে এসেছেন। তাদের প্রশ্ন করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম কূটনীতিকদের ব্রিফ করেন। এতে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তবে আগের ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টেরিটোরিয়াল ডেস্কের ডিজি ও সেগুনবাগিচায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেখা গেলেও এবার তাদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন না।
ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যে ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন, জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি ছাড়াও ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, ইতালি, জাপান, ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, স্পেন, রাশিয়া। এতে সিঙ্গাপুর, রাশিয়া, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ইইউ এবং জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ৫০ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।
উল্লেখ্য, গত ২৮ অক্টোবর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠানো এক নোটে বলা হয়, প্রতিটি নির্বাচনের আগে বিএনপি ইচ্ছাকৃতভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করে এবং অগণতান্ত্রিক শক্তিকে উৎসাহিত করতে সহিংসতায় লিপ্ত হয়। ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতা ছিল এরই ধারাবাহিকতা।