বিগত বেশ কয়েক মাস আগে সেলিম খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করে হাইকোর্টে। তার অপরাধ ছিল বিভিন্ন জায়গা থেকে তিনি বিপুল পরিমাণের অর্থ আত্মসাৎ করেন। এছাড়া সরকারি সম্পত্তি বেআইনিভাবে আত্মসাৎ করেন তিনি। তার এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। হঠাৎ করে এত প্রভাবশালী হয়ে যাওয়ায় নজর পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের। একপর্যায়ে তার বাড়ি ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় তারা। একের পর এক তার বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অবৈধভাবে ৩৪.৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সেলিম খানকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু চাঁদপুরের একটি ইউনিয়নের বিতর্কিত চেয়ারম্যান আত্মসমর্পণ করেননি। এখন তিনি গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করছেন।
মূলত সেলিম খানের এই পলাতক জীবন চলছে গত আগস্ট থেকে। সদর চাঁদপুরের ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে যান এই চেয়ারম্যান। কখনও নিজের বাড়িতে, কখনও আত্মীয়ের বাড়িতে, কখনও নদীতে নৌকায় করে রাতের পর রাত কাটান।
নিম্ন আদালত ৪ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণের দিন ধার্য করেছিল। এর তিন সপ্তাহ আগে ১৪ আগস্ট হাইকোর্ট এই তারিখ ধার্য করেছিল। কিন্তু নানা অজুহাতে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি।
তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হওয়ার আগেই তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। তার ইউনিয়নে আস্তানা গড়েছেন। মাঝে মাঝে সবার নজর এড়িয়ে ঢাকা অফিসে এলেও তাড়াহুড়ো করে এলাকায় ফিরে আসেন।
এর আগে বেশ কিছুদিন তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১২-১৩ আগস্ট নাগাদ তিনি গ্রামের বাড়িতে যান বলে জানা গেছে। তারপর আবার শুরু হয় লুকোচুরি।
দুদক মামলা দায়েরের পর গত জুলাইয়ের শেষ দিকে সেলিম খান আত্মগোপনে গেলে রাজধানীর কাকরাইল ও নারায়ণগঞ্জের ভুঁইগড় অফিসে তৎপরতা থেমে যায়। কাকরাইলের খান টাওয়ার লেন এক সময় চলচ্চিত্রের কলাকুশলীদের ভিড়ে ঠাসাঠাসি হলেও এখন অনেকটা নীরব। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের ভূইগড়েও শ্মশানের নীরবতা। যেখানে একসময় লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের মাধ্যমে নতুন সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ তৈরি হতো, সেখানে সেলিম খানের অনুপস্থিতির কারণে সব কাজ থমকে গেছে।
কাকরাইল অফিসে গিয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, সেলিম খান ব্যক্তিগত কোনো কাজে ঢাকার বাইরে ছিলেন।
অনেক দিন অফিসে না আসলেও সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন জানিয়ে ওই নিরাপত্তাকর্মী বলেন, কিছুদিন আগে একবার এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য। সে আবার চলে গেল।
সেলিম খানের মালিকানাধীন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সিনেবাজ অ্যাপ ইতিমধ্যেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার অনুমোদিত আইপি টেলিভিশন ‘ভয়েস টেলিভিশন’ চালু হচ্ছে। চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শাপলা মিডিয়ারও কোনো কার্যক্রম নেই।
জানা গেছে, দুদকের মামলার পর থেকে সেলিম খানের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অনিয়মিত হয়ে আসছে। এর আগে গত দুই ঈদে বোনাস দেওয়া হয়নি।
সেলিম খান পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে চাঁদপুরের সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর বাড়িতে অবস্থান করছেন। দুদকের মামলা হওয়ার আগেই সেলিম খান সপরিবারে ঢাকা ছেড়েছেন বলে জানা গেছে। এরপর থেকে তিনি ওই এলাকায় বসবাস করছেন। বাড়িতে স্ত্রী শাহানা বেগম, বড় ছেলে অভিনেতা শান্ত খান, ছোট ছেলে শাহীন খান ও বড় মেয়ে সেলিনা খান। ছোট মেয়ে পিংকি আক্তার ঢাকায় শ্বশুর বাড়িতে আছেন।
সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে সেলিম খানকে আজীবন বহিষ্কার করেছে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগ। এতে তিনি এখনো নিজেকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি দাবি করে এলাকায় দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করছেন।
এদিকে সেলিম খানের ছেলে চলচ্চিত্র অভিনেতা শান্ত খানের প্রায় ১৫ কোটি টাকার সন্দেহজনক স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক। এসব সম্পদের সত্যতা নিশ্চিত করতে ৫৮টি দেশি-বিদেশি ব্যাংকের এমডি ও সিইওদের কাছে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। দুদকের এমন তদন্তের কয়েকদিন আগে থেকে শান্ত খান গ্রামের বাড়িতেই অবস্থান করছেন।
শাপলা মিডিয়ার এবং শাপলা মিডিয়া বন্ধ থাকায় অনেক চলচ্চিত্রে কাজ করার চুক্তি থাকলেও তিনি গ্রামে তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা ও ক্রিকেট খেলে সময় কাটান। মাঝে মাঝে শান্ত খানকেও মোটরবাইকের বহর নিয়ে এলাকায় অনুশীলন করতে দেখা যায়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সেলিম খান গত জুলাই মাসের শেষ দিক থেকে গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। শুরুতে মতলবের মোহনপুর পর্যটন কেন্দ্রে কয়েকদিন আত্মগোপন করলেও সেখানে অবস্থানের কথা অনেকেই জানতেন বলে সেখানে থাকা নিরাপদ মনে করেননি তিনি। পরে সেখান থেকে নতুন জায়গায় চলে যান। এরপর ১২-১৩ আগস্ট নাগাদ গ্রামের বাড়িতে যান, যদিও কিছুক্ষণ তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তারপর আবার শুরু হয় লুকোচুরি। কখনো রাতের পর রাত কাটে গ্রামের নিজ বাড়িতে, কখনো আত্মীয়ের বাড়িতে, কখনো নদীতে নৌকায়।
এভাবেই দুদকের দায়ের করা মামলায় হাইকোর্টের আত্মসমর্পণের আদেশ অমান্য করে নিজ এলাকায় আত্মগোপন করছেন চাঁদপুরের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত চেয়ারম্যান সেলিম খান।
ঢাকা মহানগর পিপি আবদুল্লাহ আবু ঢাকাটাইমসকে বলেন, সেলিম খান হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে আদালতকে অবমাননা করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী তিনি এখন ফেরারি। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
দুদকের পিপি মাহমুদ জাহাঙ্গীর ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সেলিম খান আত্মসমর্পণ না করলে আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করবে। এ ছাড়া সেলিম খানের মালামাল জব্দের আবেদন করেছি, যা গত রোববার শুনানি হয়। আদালত নির্দেশ দিলে তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে।
অনেক চেষ্টার পরেও এখনো তাকে আটক করতে সক্ষম হয়নি পুলিশ। তবে বিভিন্ন সূত্রে এসকল তথ্য প্রকাশ হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। পুলিশ তাকে আটক করার জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছে।