আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের সকল রাজনৈতিক দল তাদের কৌশল এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সেই সাথে তারা দল গুছিয়ে নিতে ও নির্বাচনে সফলতা পেতে দলকে সুসংগঠিত এবং তৃনমূল পর্যায়ে নেতৃত্ব বাড়াতে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে নানা ধরনের পরিকল্পনা এবং কৌশল শুরু করলেও দলটি তাদের নেত্রীকে মুক্ত করাসহ তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সভা-সমাবেশ এবং সেই সাথে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বললেও সেটা ফলপ্রসূতা পাচ্ছে না। ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আইনগত দিক থেকে বেগম জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। এদিকে দলটি সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে জোটকে শক্তিশালী করার জন্য নতুন পরিকল্পনা নিতে শুরু করেছে। তারা বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আ.লীগকে পরাজিত করতে নতুন কৌশল নিলেও শেষ পর্যন্ত ফলাফল কী দাঁড়াবে সেটা এখন তাদের নিকট একটি বড় অনিশ্চয়তা।
সরকারবিরোধী বৃহত্ রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছে বিএনপি। ইসি গঠনে চলমান রাষ্ট্রপতির সংলাপ শেষ হওয়ার পর সমমনা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক মতবিনিময় শুরু করবে দলটি। নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে বৃহত্ ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম গড়তে ‘প্রয়োজনে’ বিএনপি তাদের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টে পরিবর্তন আনতে পারে। দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, অভিন্ন দাবিতে যুগপত্ আন্দো’লনের উদ্দেশ্যে এই ঐক্য গড়ে তুলতে চান তাঁরা।
বিএনপির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এরই মধ্যে সিপিবি, বাসদ ও ইসলামী আন্দোলন রাষ্ট্রপতির সংলাপে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আরো কয়েকটি দল এমন ঘোষণা দেবে।
এটি নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে দলগুলোর এক ধরনের মানসিক নৈকট্য বলে মনে করছে তারা। পাশাপাশি যারা সংলাপে গিয়েছে এবং যারা যাবে, তাদের অনেকেই নির্দলীয় সরকারের পক্ষে আছে। তবে এ বিষয়ে আরেকটু পরিষ্কার হতে সংলাপ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বিএনপি। তারপর ঐক্যপ্রক্রিয়া নিয়ে মাঠে নামবে।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) রাষ্ট্রপতির সংলাপের চিঠি পেয়েছে। তবে আজ বুধবার তেজগাঁওয়ের কার্যালয়ে দলের চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ সংলাপে না যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারেন। মুসলিম লীগও চিঠি পেয়েছে। তারাও সংলাপে যাবে না। মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি চিঠি পায়নি। তবে তারাও সংলাপে যাচ্ছে না। এ বিষয়ে তিন দলই বিএনপিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে স্থায়ী কমিটির সভায় জানান বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির দুই নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম ও নজরুল ইসলাম খান।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সোমবারের সভার সিদ্ধান্ত জানিয়ে মঙ্গলবার গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়, ‘সভায় নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ সম্পর্কে আলোচনা হয়। সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশের একটি জনপ্রিয় গনমাধ্যমকে বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুচিকিত্সার দাবির ফায়সালা হওয়ার পর আমরা আমাদের মূল দাবি নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন শুরু করব। এ দাবিতে ডান ও বামপন্থী সব রাজনৈতিক দলের বৃহত্ ঐক্য গড়ে তুলতে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করব।’
মির্জা ফখরুল জানান, এরই মধ্যে বাম গণতান্ত্রিক জোটের কয়েকটি দল এবং ইসলামী আন্দো’লনের সঙ্গে তাঁদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। শিগগিরই আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির দুজন নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা হয়। দুই নেতাই মনে করেন, নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সরকারবিরোধী সব পক্ষকে এক টেবিলে বসানোর যে ভাবনা নিয়ে তাঁরা এগোচ্ছেন, তা বিদ্যমান জোটকাঠামোতে সম্ভব না-ও হতে পারে। সরকারবিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতার মনোভাব থাকায় ২০ দল কিংবা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কাঠামোতে পরিবর্তন হতে পারে। তবে বৃহত্ ঐক্যের দলগুলোর মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো জোট গঠন না করে যুগপত্ আন্দো’লনের কথাই ভাবছেন তাঁরা।
দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা বলেন, এরশাদবিরোধী আন্দোল’নে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাত দল এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দল যুগপত্ আন্দোলন করেছিল। পরস্পর বিরোধী দলগুলো একটি দাবিতে এক হয়েছিল; এবারও সেই রকম হতে পারে। যেমন—বিএনপি নেতৃত্বধীন ২০ দলীয় জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী দলগুলোসহ বিভিন্ন জোট যার যার অবস্থান থেকে একই দাবিতে যুগপত্ আন্দোলন করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় পরস্পরবিরোধী দলগুলোর মধ্যে সরকারবিরোধী বৃহত্ ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব।
এ লক্ষ্যে বিএনপি কয়েক মাস আগে একটি রূপরেখাও তৈরি করেছে। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ১১ থেকে ১৩ দফার ওই রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবে দলটি, যেখানে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা, খালেদা জিয়াসহ সব ‘রাজবন্দির’ মুক্তি, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন, কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে সুশাসনের অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে অনেক দলের মতের মিল থাকলেও জামায়াত থাকায় কেউ ওই জোটে আসছে না। জামায়াত ২০ দলীয় জোটে থাকায় দেশি-বিদেশি অনেকেই বিএনপির সমালোচনা করে, যার কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তাই অভিন্ন দাবিতে বৃহত্ ঐক্যের পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছে বিএনপি।
এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গনমাধ্যমকে বলেন, ‘বাম দলগুলো রাজনীতির অলংকার। আর বিএনপি হচ্ছে বৃহত্ শক্তি। এ দুইয়ের সঙ্গে ডানপন্থী দলগুলোর ঐক্য হলে জনগণ উদ্বুদ্ধ হবে।’
দলীয় সূত্র জানায়, গত সোমাবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় এ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত হলে ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের সংলাপে অংশগ্রহণের বিষয়ে সমালোচনা করেন কয়েকজন নেতা। ঐক্যফ্রন্টে শরিক হয়েও তারা কিভাবে সংলাপে অংশ নিল এ নিয়ে কামাল হোসেনকে ‘জিজ্ঞেস’ করা উচিত বলে কয়েকজন মন্তব্য করেন। তবে সভায় সংলাপ শেষ হওয়ার আগে এ বিষয়ে কোনো কথা না বলার সিদ্ধান্ত হয়।
বিএনপির উদ্যোগের ব্যাপারে বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি গনমাধ্যমকে বলেন, ‘ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র। এই দাবিতে আমরা মাঠে আছি। বিএনপিও একই দাবিতে লড়াইয়ে আছে। এটি ইতিবাচক। কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
এদিকে, সাজাপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দিকে কোনো সক্রিয়তা দেখাতে পারছেন না তাছাড়া তিনি অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল পর্যায়ে আসছে এমনটি জানিয়েছেন তার চিকিৎসকেরা। সেই দিক থেকে আসন্ন নির্বাচনে খালেদা জিয়ার কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদিকে বিএনপির ভাইস-প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান বিদেশে থেকে দেশের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা দিলেও সেটা কতটুকু ফলপ্রসূতা পাবে সেটা রাজনৈতিক পর্যায়ে দেখা গেছে। তবে এখন ভরসা হলো বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা, তাদেরকেই দলে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে হবে এমনটি মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।