বর্তমানে এক মহামরীর মধ্যদিয়েই যেতে হচ্ছে সারাবিশ্বকে। তবে এরপরও সচেতনার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রায় সবার মাঝেই। আর এর ফলে নানা অসুস্থতায় পড়তে হচ্ছে কাউকে না কাউকে। সম্প্রতি এবার এমনই একটি দৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে রাজধানী ঢাকাতে। যেখানে গতকাল মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) দেখা যায়, রাজধানীর বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকা লাগোয়া হাজী রেস্তোরাঁর পুরো এলাকা ধুলাচ্ছন্ন। কারও মুখে মাস্ক নেই। যে যেভাবে পারছেন টেবিলে বসে খাচ্ছেন। পাশে ব্যাগ দেখেই বোঝা গেল বিদেশ যাবেন। সঙ্গে আরও দুজন। দুবাই প্রবাসী জাকির, গাইবান্ধার পলাশবাড়ি থেকে গতকাল সকালেই ঢাকায় এসেছেন। উঠেছেন আশকোনার হোটেল পারভীন নামের এক আবাসিক হোটেলে। করোনা পরীক্ষাসহ নানা ঝক্কি এড়াতে আগামী দুই দিন থাকবেন হোটেলে, খাবেন আশপাশের রেস্তোরাঁয়।
জাকিরের মতো মধ্যপ্রাচ্যে কাজে যাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকেরা উড়োজাহাজে উঠলেও কর্মক্ষেত্রে পৌঁছানোর আগে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এদের মধ্যে কেউ উড়োজাহাজে, আবার কেউ কেউ গন্তব্যে গিয়ে অসুস্থ হচ্ছেন। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো উদ্বিগ্ন। কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)-এর বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। খবর গেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছেও।
শ্রমিকদের ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, বমি ও কলেরা জনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান। গতকাল তিনি বলেন, ‘যেহেতু বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রীরা যায়, তাই এর একটি পক্ষ হচ্ছে বেবিচক। এখানে দেখতে হবে কারা আক্রান্ত হচ্ছেন। যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁরা সবাই শ্রমিক শ্রেণির।’ তিনি বলেন, সম্প্রতি এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে বৈঠক হয়েছে। সেখানে কিছু দিকনির্দেশনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে যারা বিদেশ যাবেন তারা বাংলাদেশ থেকে খাবার নিতে পারবেন না এমন সিদ্ধান্ত আসছে।
গতকাল রাজধানীর বিমানবন্দর গোলচত্বর ও আশপাশের এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, বিদেশগামী যাত্রীদের থাকা খাওয়ার ওপরে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এই এলাকার আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ ব্যবসা। এদের বেশির ভাগই মানুষের চাপে হিমশিম খাচ্ছে। অন্য জায়গায় যেন না যায় তাই আগেভাগে গ্রাহকদের খাবার সরবরাহ করাই মুখ্য এসব রেস্তোরাঁর কর্মীদের কাছে। ফলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যকর ইত্যাদি শব্দগুলো একেবারে গৌণ সেখানে। সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় সব হোটেলেই জার থেকে গ্রাহকদের খাবার পানি দেওয়া হচ্ছে। তবে তার পুরোটাই সংগ্রহ করা হয় আশপাশের ওয়াসার পাম্পগুলো থেকে। যে জারগুলোতে পানি ভরে আনা হয় সেগুলোও ভয়াবহ রকমের অপরিষ্কার। অন্যদিকে, বিমানবন্দর মোড় এলাকা জুড়ে দীর্ঘ দিন ধরে উন্নয়নকাজ চলায় সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে শ্বাস নেওয়াই কষ্টকর হয়ে যায়।
বিমানবন্দর গোলচক্করের মসজিদ মার্কেটের ওপরে আল আমিন রেস্তোরাঁ ও হোটেল, এয়ারপোর্ট হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। দক্ষিণখান আশকোনা এলাকায় হোটেল থ্রি স্টার, হোটেল সেতু, হোটেল শাহজালাল, হোটেল সততা, পারভিন হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, মক্কা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট নামে বাহারি সব হোটেল রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই এলাকায় অন্তত ৩০টি হোটেলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় হাজারখানেক প্রবাসী শ্রমিক থাকেন। দিনে ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত একেকটি কক্ষের ভাড়া। সেখানে থেকে আশপাশের রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া করেন তাঁরা।
এ নিয়ে প্রশ্ন করলে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ‘তারা গরিব মানুষ, ঢাকায় এসে বাইরে থাকেন। হোটেলে বসেন, খাওয়া দাওয়া করেন। খাবারগুলো অস্বাস্থ্যকর। এ কারণে তার প্রভাব পরেছে। এ বিষয়ে সচেতন করতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আরব আমিরাতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠক করেছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সেখানে ছিলেন। সেখানে যৌক্তিক একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করা হয়। এ জন্য বেশ কিছু করণীয় ঠিক করা হয়েছে।’ তবে সেগুলো কী কী তা জানাতে পারেননি তিনি।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে দুটি গন্তব্যে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো দুটি রোগকে খুবই ভয় পায়। একটি হলো যক্ষ্মা, আরেকটি হলো কলেরা। আর শ্রমিকদের কলেরার লক্ষণ দেখা গেছে। ফলে এ লক্ষণ আরও দেখা গেলে হয়তো শ্রম বাজারই সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেবে তারা।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বরে শ্রমিকদের অসুস্থ হয়ে পড়ার এমন ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। বাংলাদেশি শ্রমিকদের আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলে শ্রমবাজার সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ার কথাও তারা জানিয়েছে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে কাতারে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে গ্রাউন্ড রিয়্যালিটি বিবেচনায় নিতে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ।’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে মাসে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক বাইরে গেছেন, যা যথাক্রমে ১ লাখ ২ হাজার ৯৬১ এবং ১ লাখ ৩১ হাজার ৩১৬ জন। এর মধ্যে গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৯ হাজার ২০২ ও কাতারে ১১ হাজার ১৫৮ জন কর্মী গিয়েছেন।
দেশের উন্নয়ের পেছনে প্রবাসীদের অবদান কখনও ভোলার নয়। প্রায় প্রতিবছরই তাদের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর ভিত্তি করেও এদিয়ে যাচ্ছে এ দেশে। আর এদিকে তাদের জন্য সর্বদা কাজ করে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মাননীয় প্রধানমনত্রী শেখ হাসিনা। প্রবাসীদের দুশ্চিন্তা দূরীকরণে রীতিমতো কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।