আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র নানা ধরনের আলোচনা চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। বিগত দুটি সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি এমন বিতর্ক রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। বিরোধী দল বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহন করবে না বলে দলের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। যদিও বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে তাদের বিতর্ক থাকলেও তাদের দাবি নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটের পক্ষে থাকতে ইসির তোড়জোড়।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক করে আসছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এবার রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকে ইভিএম দেখানো হলেও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। এর আগে যারা ইভিএমের বিপক্ষে ছিল তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এতে আপত্তি জানালেও ইসি ছাড় দিতে রাজি হয়নি। ইভিএমের পক্ষে আওয়ামী লীগের অবস্থানকে ইসির জন্য ‘চাপ’ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের মুখে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কড়া নাড়ছে। দেড় বছর পর নির্বাচন। তাই নির্বাচনের নানা প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। এর অংশ হিসেবে গত দুই সপ্তাহে ইভিএম নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টির সঙ্গে মতবিনিময় করেছে ইসি। বিএনপিসহ ১১টি রাজনৈতিক দল ইসির আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে।
জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি আসন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধীতার কথা জানিয়েছে। তারা বলছেন, ইভিএমের চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কর্মকর্তারা নিরপেক্ষ থাকবেন কি না। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে অবস্থান জানিয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন জোটের শরিকরা ইভিএমের পক্ষে ভোট দিলেও এর ত্রুটিগুলো তুলে ধরেছে।
ইসি সূত্র জানায়, ইসির অনুরোধে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো প্রদর্শনের জন্য ইসি চত্বরে ইভিএম মেশিন খোলা হয়। কিন্তু একজনও সেখানে যাননি। তারা সরাসরি সভায় প্রবেশ করেন এবং বক্তব্য দিয়ে চলে যান। ইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ইসির পক্ষে আসলে নির্বাচন করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় এখনো কাটেনি। এ কারণে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর প্রতিনিধিরা ইভিএম নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাননি। কারিগরি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মাত্র পাঁচটি দল ইভিএম দেখতে গেছে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, মতবিনিময় শেষে বৈঠকের কার্যবিবরণীতে সব পক্ষের বক্তব্য উল্লেখ করলে বিপাকে পড়েন ইসির সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা। কারণ, অনেকের বক্তব্য পরিষ্কার নয়। তারা ইভিএমের পক্ষে না বিপক্ষে তা বোঝার উপায় নেই। তারা বিষয়টি সিইসিকেও জানিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বৈঠকের বক্তব্য রেকর্ড করার পাশাপাশি ভিডিও ক্লিপ তৈরিরও পরামর্শ দেন সিইসি।
ইসির যুগ্মসচিব এসএম আসাদুজ্জামান জানান, বৈঠকে প্রতিটি পক্ষ থেকে কারিগরি বিশেষজ্ঞসহ সর্বোচ্চ চারজনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ইসি। কিন্তু বেশিরভাগ দলই কারিগরি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেয়নি। কয়েকটি দলে এ ধরনের প্রতিনিধি থাকলেও তারা শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। ইভিএমের সমস্যা বা সম্ভাবনা নিয়ে তাদের আগ্রহ কম ছিল।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, ক্ষমতাসীন দল চাইলেও ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট করার সক্ষমতা ইসির এ মুহূর্তে নেই। তাড়াহুড়ো করে যন্ত্র সংগ্রহ করা হলেও তা চালানোর জন্য দক্ষ জনবল তৈরি হতে অনেক সময় লাগবে। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশের ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। ইসির কাছে এই মুহূর্তে যতগুলো মেশিন রয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ ১০০টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা যাবে। তবে ইসির পরিকল্পনা রয়েছে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বিভাগীয় সিটির আসনসহ সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৭০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা যাবে।
রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে ইসির দৃঢ় অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসি কর্মকর্তারা বলেন, ভোটকেন্দ্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ইভিএম অনেক বেশি ইতিবাচক। কারণ, ব্যালট বাক্স ও পেপারের ব্যালট কেন্দ্র থেকে ছিনতাই হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ইভিএমে এমন কোন ভয় নেই।
নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেন, ইসির আমন্ত্রণে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পর্যালোচনা করা হচ্ছে। অধিকাংশ পক্ষের পক্ষে কারিগরি বিশেষজ্ঞরা বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন। যারা বিশেষজ্ঞ দল নেননি, তাদের কোনো আপত্তি নেই বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, কোনো আপত্তি থাকলে তারা বিশেষজ্ঞ এনে তাদের সমস্যা তুলে ধরতেন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ক্ষমতাসীন দল পুরো ৩০০ আসনে ইভিএম দাবি করায় ইসি কিছুটা চাপে আছে বলে মনে হচ্ছে। যারা এর বিরোধিতা করে তাদের মধ্যে রয়েছে আস্থার সংকট। তিনি বলেন, শুরুর ইভিএম এবং বর্তমান ইভিএমের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে।
কমিশনের সদস্য সাবেক সিইসি কাজী রকিব আরও বলেন, তারা যখন দায়িত্বে ছিলেন, তৎকালীন কমিশন বিতর্ক এড়াতে ইভিএম ব্যবহারের দিকে এগোয়নি। তারপরও যারা ইভিএমের বিপক্ষে ছিল তারা এখনো তাদের বিপক্ষে।
তিনি বলেন, তাদের আগ্রহ-অনিচ্ছা এবং সাম্প্রতিক নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে কমিশনের অভিজ্ঞতা- সার্বিক বিষয়গুলো বিভিন্ন পর্যায়ে ইসি বিশ্লেষণ করছে। চলতি মাসেই ইভিএম নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায় ইসি। সবকিছু পর্যালোচনা করেই সিদ্ধান্ত হবে- কোন পদ্ধতিতে, কতটি আসনে ও কীভাবে নির্বাচনে যাবে ইসি।
ইভিএম-এর ভালো-মন্দ কারা: ইসি-তে নিবন্ধিত ১১টি দল আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেও, ২৮টি দল অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরিকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল-এমএল, গণতন্ত্রী পার্টি, জাতীয় পার্টি-জেপি, বিকাশধারা বাংলাদেশ, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট-বিএনএফ তাদের আগ্রহ বা আপত্তি জানিয়েছে। ইভিএম ব্যবহার। পিপলস ফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি।
এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দল অবশ্য বলেছে, তারা ইভিএমের পক্ষে থাকলেও জনমত এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বেশ কয়েকটি দল অবশ্য শর্ত সাপেক্ষে ইভিএমের পক্ষে তাদের অবস্থান জানিয়েছে।
ইভিএম বিরোধী দলগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম, বাংলাদেশ কংগ্রেস, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খিলাফাহ আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খিলাফাহ মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ খিলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খিলাফত মজলিস। গণফোরাম, বাংলাদেশ ন্যাপ ও বাংলাদেশ কালচারাল লিবারেশন অ্যালায়েন্স।
ইসির সংলাপে না যাওয়া দলগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)।
প্রসঙ্গত, অনেক রাজনৈতিক দল বিরোধীতার পরও নির্বাচন কমিশন পক্ষে হতে ইভিএমের মাধ্যমে আগামী নির্বাচন করার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে চায় ইসি। চলতি মাসেই আলোচনার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।