রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের অষ্টম তলার ফ্ল্যাট থেকে পড়ে সাত বছর বয়সী গৃহকর্মী ফেরদৌসি। শিশুটির যৌনাঙ্গে অস্ত্রোপচারসহ দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলছিল।
তার পরিবার বিচার চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল, অভিযোগ করে যে এটি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত নিষ্ঠুরতা ছিল। কিন্তু দৃশ্যপট বদলে গেল মাত্র ৪০ দিনে।
মা নিজেই, যিনি মেয়ে শিশুর বর্বরতার বিচার চেয়েছিলেন, পরে অভিযুক্তকে খালাস দেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেছিলেন। এভাবে টাকার বিনিময়ে মামলা মোড় নেয়।
ওই ঘটনার ছয় মাস পর একই ফ্ল্যাট থেকে পড়ে আরেক গৃহকর্মী প্রাণ হারালে নতুন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তদন্তে জানা যায়, মামলা দায়েরের পর থেকে আসামিরা নিরীহ পরিবারকে অব্যাহতভাবে চাপ দিয়ে আসছিল।
প্রভাবশালী সাংবাদিক হওয়ায় ফেরদৌসির বাবা-মা টিকতে পারেননি। একপর্যায়ে অর্থের প্রলোভনে গরিব পরিবারটি কি করতে বাধ্য হয়। তাদের লিখিত বক্তব্যে ওই মামলা থেকে আসামিদের খালাস দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়।
এদিকে প্রভাবশালী এই সাংবাদিককে ঘিরে নতুন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় গত ৮ ফেব্রুয়ারি।
এদিন প্রীতি ওরাং নামের এক কিশোরী গৃহকর্মী একই ফ্ল্যাটের অরক্ষিত জানালা থেকে নিচে পড়ে প্রাণ হারান। যখন প্রীতির রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করা হয়, তখন তার শরীরের বেশিরভাগ অংশই ছিল বস্ত্রহীন। তা দেখে প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় লোকজন বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পরে এ নিয়ে বিক্ষোভ হয়। তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন।
জানা যায়, ২০২৩ সালের ৪ আগস্ট মোহাম্মদপুর থানার শাহজাহান রোডের ২/৭ নম্বর বাড়ির অষ্টম তলার ৮/সি নম্বর ফ্ল্যাটের জানালা থেকে নিচে পড়ে যান ফেরদৌসী। ঘটনার দুই দিন পর শিশু গৃহকর্মীর মা জোসনা বেগম বাদী হয়ে সৈয়দ আশফাকুল হক, তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারসহ তিনজনকে আসামি করে মামলা করেন।
আদালতের মোহাম্মদপুর থানার সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক হেলাল জানান, এ মামলায় আসামিদের খালাস দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন এখনও গ্রহণ করা হয়নি। এই রিপোর্ট পাওয়ার তারিখ ধার্য করা হয়েছে।
তবে মামলার বাদী জোসনা বেগম স্বেচ্ছায় সমঝোতার কথা বলছেন। মামলার খরচ মেটাতে না পারায় তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। এ ছাড়া ফেরদৌসীর চিকিৎসার জন্য আসামিপক্ষ আর্থিক সহায়তা করেছেন। মামলায় আপস করলে আরও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এ জন্য তিনি স্বেচ্ছায় আসামিদের মুক্তি চেয়ে লিখিত বক্তব্য দেন।
এর আগে গত বছরের ৬ আগস্ট ঘটনার দুই দিন পর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন জোসনা বেগম। মামলার আরজিতে জোসনা বলেন, দারিদ্র্যের কারণে সাত বছরের মেয়েকে গৃহপরিচারিকা হিসেবে দেন। কিন্তু সৈয়দ আশফাকুল ও তার স্ত্রী তানিয়া ওই ছাত্রীকে নিয়মিত নির্যাতন করতে থাকে। এ ছাড়া তাকে অবহেলাও করতেন। এসব খবর শুনে তারা মেয়েটিকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তাদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে অষ্টম তলার অরক্ষিত জানালা থেকে লাফ দেন ফেরদৌসী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাদী জোসনা বেগমের ভাগ্নে মোস্তাক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ফেরদৌসীর চিকিৎসার খরচ আশফাকুল হক বহন করেছেন। এ ছাড়া তিনি আদালতের মাধ্যমে দুই লাখ টাকাও দিতে চেয়েছিলেন। খুব শিগগিরই মামলার নিষ্পত্তি হতে পারে।
ভয়ে মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে মোস্তাক আহমেদ এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে একমাত্র ফেরদৌসির মা জোসনা বেগমই ভালো বলতে পারেন।
ফেরদৌসীর একাধিক স্বজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক অপরাধী বাদীর আর্থিক স্বচ্ছলতা নিয়ে পালিয়ে যায়। এখানেও বিরক্ত করা হয়নি। এ নিয়ে কেউ খোলাখুলি কথা বলতে না চাইলেও এক ধরনের চাপা ক্ষোভ রয়েছে। এত অল্পবয়সী মেয়ের উপর যে বর্বরতা চালানো হয়েছে তা ভুলা যায় না।
তদন্ত কর্মকর্তা ও মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক মো. মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে রাজীব হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, বাদী নিজেই আদালতের মাধ্যমে আসামিদের সঙ্গে মীমাংসা করেছেন। আমরা আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছি। প্রতিবেদন গ্রহণ করে আদালত পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।
এদিকে ডেইলি স্টার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারের অষ্টম তলার ফ্ল্যাট থেকে পড়ে প্রীতি ওরাং (১৫) এর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। প্রায় একই কায়দায় ছয় মাসের ব্যবধানে দুটি ঘটনায় হতবাক বাসিন্দারা। স্থানীয়দের সন্দেহ, এই ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা বা ‘অবহেলায় মৃত্যু’ নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।