২০২২ সালের ৩০শে ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো সরকারকে উৎখাতের জন্য একযোগে কর্মসূচি শুরু করে। ওই দিন থেকে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সমান্তরালভাবে এ কর্মসূচি পালিত হয়। দ্বাদশ নির্বাচনের পর বিএনপি ও বিরোধী দলগুলো নতুন নির্বাচনের দাবি জানালেও এ ধরনের কর্মসূচিতে যাচ্ছে না। পরিবর্তে, দল এবং জোটগুলি জনগণ ভিত্তিক সমস্যা এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তাদের নিজস্ব উপায়ে পৃথক কর্মসূচি পালন করবে।
বিএনপি ও যুগপৎ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, তিনটি বিষয় মাথায় রেখে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন তারা। প্রথমত, কারাবন্দি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতাদের মুক্তি; দ্বিতীয়ত, অন্যান্য সমমনা বিরোধী দলের অবস্থান ও কর্মকাণ্ড এবং তৃতীয়ত, সরকারের আচরণ।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো মনে করছে, এই তিন বিষয়ের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক দিকটিও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের নজরে রয়েছে। পাকিস্তানে চলমান নির্বাচন, ভারতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন এবং মিয়ানমারের পরিস্থিতিও বিবেচনায় নিচ্ছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।
গণতন্ত্র মঞ্চের প্রভাবশালী এক নেতা বলছেন, যুগপৎ কর্মসূচিতে এক ধরনের ভাটা এসেছে। নির্বাচনের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির সঙ্গে বৈঠক হলেও এরপর কোনও ‘ফলোআপ’ করা হয়নি। সর্বশেষ ১৩ জানুয়ারি গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি; যার সূত্রপাত হয় ৯ জানুয়ারি ১২-দলীয় জোটের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে। প্রায় এক মাস পার হলেও ওই বৈঠকগুলোর কোনও মূল্যায়ন করতে পারেনি বিএনপি।
মঞ্চের আরেক নেতা দাবি করেন, বিএনপি ইতিমধ্যে ‘গো স্লো’ নীতির কথা বলেছে। তবে একযোগে কর্মসূচি দিতে গেলে আবার আলোচনা করেই করা হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দলগুলো তাদের স্বতন্ত্র ও জোটগত কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে।
গণতন্ত্র ফোরামের অন্যতম নেতা জোনায়েদ সাকি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলন চলবে। এর মধ্যে দল ও জোটগুলো আন্দোলন-কর্মসূচি নিয়ে পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করবে এবং নেতাকর্মীদের মুক্তি, মামলা মোকাবিলার বিষয়গুলো রয়েছে।’
গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক আরও বলেন, একতরফা নির্বাচন বাতিল, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, অরক্ষিত সীমান্ত, ব্যাংক ডাকাতি বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবিতে সভা-সমাবেশ চলছে। চলমান আন্দোলনে জনগণকে আরও সম্পৃক্ত করতে নতুন কৌশল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলছে।
মঞ্চের আরেক নেতা বলেন, ‘আন্দোলনে যাওয়ার একটা সমীকরণ আছে। নিজেরা মুভমেন্ট করতে গেলে এক রকম। স্বতঃস্ফূর্ত হলে আলাদা। এ জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মঞ্চের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা মন্তব্য করেছেন, ‘বিএনপি দলের নেতাদের মুক্তির বিষয়টিকেই এখন প্রাধান্য দিচ্ছে। একই সঙ্গে সরকারের আচরণও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বিষয়টিকে বোঝার জন্যই বিএনপির নেতৃত্ব অপেক্ষা করছে। কারাগারে থাকা নেতারা বের হলে আলোচনার মধ্য দিয়ে ‘কমন লাইন অব অ্যাকশনে’ পৌঁছানো জরুরি। এরপর আগামী মাসে রোজা আছে। ইফতার মাহফিলের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়া উন্নতি ঘটতে পারে। সব মিলিয়ে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি আসতে পারে।
বিএনপির সঙ্গে অন্তত ৩৯টি রাজনৈতিক দল একযোগে কর্মসূচি পালন করছে। এসব দল ও জোট হলো গণতন্ত্র মঞ্চ (৬ দলীয় জোট), ১২ দলীয় জোট, গণফোরাম-পিপলস পার্টি (দুইদলীয় জোট), সমনা জোট (১১), গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য (৪ দল)। এককভাবে পালন করেছে বিএনপি, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রথম একযোগে কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল একটি সমাবেশ। এরপর ২০২৩ সালের ১৮ জুলাই ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার’ এক দফা দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে একযোগে পদযাত্রা কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি আরও বলেন, বিদায়ী বছরের ২৯ অক্টোবর থেকে ৫ দফা হরতাল, ১৩ দফা অবরোধ ও ১৩ দফা গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করা হয়। সর্বশেষ কালো পতাকা মিছিল হয় চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি।
বিএনপি ও বিরোধী দলের একাংশও যুগপৎ ঢং পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। বেশ কয়েকটি দলের নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগে জামায়াত একসঙ্গে প্রচারণা না করলেও এবার কিছু দল তাদের তৎপরতা শুরু করেছে।
বিএনপির ডানপন্থী নেতারা ইতোমধ্যে কয়েকটি ধর্মীয় দলের অনুষ্ঠানে যাওয়া শুরু করেছেন। এছাড়া বিরোধী দলগুলোর মধ্যে জামায়াত-প্রভাবিত দলগুলোও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এই দলের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে যেতে চায়। এরই মধ্যে জামায়াত নেতা মাওলানা আবদুল হালিমের নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে বেশ কয়েকটি দলের মধ্যে অস্বস্তি বেড়েছে। এরইমধ্যে ১২ দলীয় জোটের একটি প্রোগ্রামে জামায়াত নেতা মাওলানা আবদুল হালিমের অংশ নেওয়াকে কেন্দ্র করে একাধিক দলের মধ্যে অস্বস্তি বেড়েছে। সব মিলিয়ে যুগপতের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ও কৌশল নির্ধারণে খানিক সময় নেবে বিএনপি ও যুক্ত দলগুলো, এমনটাই বলছেন বিরোধী দলের একাধিক নেতা।
জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপি কোনও বিপ্লবী দল নয়, বিএনপি হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক দল; গণতান্ত্রিক নর্মস মেনে রাজনীতি করছে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। বিএনপির ডাকে মানুষও ভোট দেয়নি। এতে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। আমাদের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির দুজন সিনিয়র সদস্যসহ হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। গত ২৪ ঘণ্টায় গ্রেফতার হয়েছে ১১ জন।’
সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য, ‘বিএনপি ও যুগপৎধারায় যুক্ত দলগুলোর আন্দোলন থামেনি। আমরা আন্দোলনে আছি। আন্দোলনের একটি স্তর পার করেছি আমরা। এখন দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অর্থনৈতিক দুরবস্থায় জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। আমাদের আন্দোলন আরও বেগবান করার চেষ্টা করছি।’