আমাদের চারপাশে এমন অনেক ধরনের ঘটনা মাঝে মধ্যে ঘটে যা অনেক সময় সিনেমার সাদৃস্য খুজে পাই এই ঘটনার মধ্যে। তবে কিছু ক্ষেত্রে যেসকল ঘটনা সিনেমার মধ্যে দেখি ও ঘটনাই বাস্তবে অনেক জায়গায় দেখা মেলে। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায়। ছোট শিশুর সামনে বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা। খুনিদের বিচার নিশ্চিত করতেই একদিন আইনজীবী হয়ে ওঠে শিশুটি। বাবার হত্যা মামলা তিনি নিজেই লড়েন এবং হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করেন।
হাফেজ হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। টাকা চাইতে গিয়ে তার বাবা নুরুল কবিরকে স্বজনরা নির্মমভাবে হত্যা করে। বাবার মৃত্যুর পর তার পরিবার অথৈ সাগরে তলিয়ে যায়। অভাব-অনটনে ঘেরা। সে অবস্থায় মামলার খরচ থেকে দূরে থাকলে তার পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ছিল এরশাদের। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পর হত্যা নয়, আইন এর মাধ্যমে হত্যার প্রতিশোধ নিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। তখন থেকেই তার কঠোর পরিশ্রম শুরু হয়। আইনে সফলতার সাথে ডিগ্রি অর্জনের পর ব্যারিস্টার হিসেবে নথিভুক্ত হন।
২২ বছর আগে বাবাকে হারানো এরশাদ তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল পেয়েছেন সোমবার। এদিন বাবাকে হত্যার দায়ে চারজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ফেরদৌস ওয়াহিদের আদালত এ রায় দেন। এরশাদ নিজেও আইনজীবী হিসেবে মামলায় লড়েছেন।
দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- লোহাগড়া উপজেলার আধুনগর ইউনিয়নের রুস্তম পাড়ার বাসিন্দা নূর ইসলাম, তার ছেলে ওসমান গণি, সারোয়ার কামাল ও আব্বাস উদ্দিন।
নুরুল কবির তার বড় ভাই নুর ইসলামের ছেলেকে বিদেশে যাওয়ার জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ধার দেন। পরে ওই টাকা দাবি করলে নূর ইসলাম ও তার ছেলেদের সঙ্গে নুরুল কবিরের কথা কাটাকাটি হয়। ফলে ১৯৯৯ সালের ৬ ডিসেম্বর বাড়িতে হামলা হলে নুরুল কবির আজলা পুকুর পাড়ে পালিয়ে যান। সেখানে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে চোখ ও মাথায় আঘাত করে তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নুরুল কবিরের স্ত্রী খালেদা ইয়াসমিন বাদী হয়ে লোহাগড়া থানায় ছয়জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ ২০০২ সালের ২১ ডিসেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পরে ১৩ জানুয়ারি ২০০৩ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরি করা হয়। এ মামলায় ১৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। আসামি তিনজনের সাক্ষ্যও গ্রহণ করেন।
হাফেজ হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ বলেন, বাবার পাওনা টাকা ফেরত দেওয়ার লড়াই শুরু করেন জেঠা ও তার ছেলেরা। এক পর্যায়ে বাবা বিদেশ থেকে আসেন। টাকা পরিশোধে সালিশ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু টাকা না দিয়ে বাবাকে খুন করে।
এরশাদ বলেন, বাবাকে যখন হত্যা করা হয় তখন আমি চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বাবার ঘটনার পর থেকেই আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল আমাকে আইনজীবী করা। আমিও আমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে এবং আমার বাবার হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে কঠোর পড়াশোনা করেছি। পরিবারের সবাই প্রবাসী হওয়ায় কাতার থেকে আমার জন্য ভিসা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বাবা হত্যার বিচারের জন্য তিনি বিদেশে যাননি।
এরশাদ বলেন, বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। তার বড় ভাই মোহাম্মদ আইয়ুব এলাকায় একটি মুদির দোকান চালাতেন। বাকি তিন ভাই বিদেশে চলে গেছে। পরে বড় ভাইও বিদেশে চলে যায়। এতে পরিবারের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে আমরা আইনজীবীর ফি দিতেও পারতাম না।
এরশাদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অনার্স শেষ করে ২০১১ সালের শেষ দিকে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতিতে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে যোগদান করি। ২০১২ সাল থেকে বাবার মামলার যাবতীয় কার্যক্রম দেখাশোনা শুরু করি। ৯ বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘোরাফেরা করতে যে কষ্ট আমার হয়েছে, তা আমি কখনো চিন্তাও করিনি। ২০০৩ সালে আদালতে মামলার বিচার শুরু হয়। আদালতে আসতে আমার মা ও ভাইকে গ্রাম থেকে অনেক দূর যেতে হতো। মা মাঝে মাঝে বিরক্ত হতেন। তখন আমি মাকে সাহস দিতাম, বলতাম ধৈর্য ধরলে ফল পাবে।
ছেলের সামনে বাবাকে না ফেরার দেশে পাঠানোর পর আইনের মাধ্যমে বাবার সেই মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছে ছেলে চট্রগ্রামের ছেলে এরশাদ, লেখা পড়া শিখে আইনজীবি হয়ে তিনি দেখিয়েছেন হত্যার প্রতিশোধ হত্যা দিয়ে নয় বরঙ আইন দিয়ে করা যায়। তিনি বলেন, রায় ঘোষণার সময় মা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায়ে তিনি খুশি। রায় কার্যকর হলে আমরা আরও খুশি হব।