আমরা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, কারণ উজান থেকে আসা পানি এবং ভারী বর্ষণে অনেক গ্রাম ও শহর প্লাবিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি এক সপ্তাহ ধরে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই অঞ্চল থেকে আসা খবর একটি ভয়াবহ চিত্র আঁকা, প্লাবিত হয়েছে প্রচুর রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ও ফসলি জমি। মানুষ বন্যার পানিতে আটকা পড়েছে বা বন্যা কেন্দ্রে আশ্রয় নিচ্ছে। খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার স্কুলগুলি হয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বা আশ্রয়কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে। অনেক বন্যাপ্রবণ এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। এ অবস্থায় মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টে আছে।
নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে পানির উচ্চতা কমলেও অন্যান্য উপজেলায় তা বাড়ছে। কোমর পানিতে গৃহবন্দী মানুষ। নৌকায় বাড়ি থেকে মূল সড়কে যেতে হয়। এমন অবস্থায় নিথরদেহ দাফন করতে হয়েছে রান্নাঘরে। দেখা গেছে, পুরো এক সপ্তাহে জেলার ১০টি উপজেলার পাঁচ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্রথম বন্যা কবলিত কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর এলাকায় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা চালালেও উধাখালী ও কংশ নদী এখন অন্য এলাকায় প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার (২২ জুন) জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের মাদল গ্রামের আলী উসমানের ছেলে সলিমুদ্দিন (৬৫) প্রয়াত হন। এলাকার কবরস্থান ও গ্রামীণ সড়কে পানি থাকায় স্বজনরা তাকে রান্নাঘরে দাফন করে।
এলাকাবাসী ও সলিমউদ্দিনের ছেলে বলেন, বাবা বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। মঙ্গলবার সকালে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। কিন্তু কোমরের পানির কারণে তাকে হাসপাতালে নেওয়া যায়নি। পরে বিকেলে বাবা প্রয়াত হন। কোমর পানিতে কবরস্থানেও দাফনের উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত জানাজা ছাড়াই রান্নাঘরের ভেতরেই তাকে দাফন করতে হয়।
একই উপজেলার মাইঝপাড়া গ্রামের বকুলা আক্তার বারান্দায় চুলা বসিয়ে দুদিন পর হাঁড়িতে ভাত রাখেন। স্বামী সেকান্দার ৪০ দিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রয়াত হন। বাড়িতে ৪০ দিনের আয়োজন তো দূরের কথা, তারা কোনো আলেমকেও খাওয়াতে পারবেন না। সেজন্য তিনি বারান্দায় চুলা পেতে মাদ্রাসার দুই এতিম ছাত্রকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। এদিকে যাদবপুর, সিংরাজানা, বিছরাকান্দা ও মাদল এলাকার শতাধিক বাড়িতে হাঁটু পানি থাকলেও কোনো সহযোগিতা নেই। অনেকেরই খাবার আনতে ডুবে যাওয়া রাস্তা পার হওয়ার উপায় নেই। বেশ কিছু মানুষ ট্রলারে করে চলে যাচ্ছে। আটপাড়া নেত্রকোনা প্রধান সড়কের পাশে খোলা জায়গায় গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে কয়েকটি পরিবার। গৃহবন্দী অগণিত মানুষ। নারী ও শিশুরা ঘর থেকে বের হতে পারছে না। তাদের নৌকাই একমাত্র ভরসা। এক ঘরের ডিঙি নৌকা এখন কয়েকটি বাড়ির ভরসা। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে সবাইকে নৌকায় করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয়। আটপাড়া উপজেলার যাদবপুরে চুলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় রান্না বন্ধ করে দিয়েছে ৫০টি পরিবার।
উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, বন্যা কবলিত জেলায় একদিনে ২৮ জনের প্রয়ান হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার নিয়ন্ত্রন কক্ষ্য থেকে এ তথ্য জানা গেছে। প্রাথমিকভাবে, ২৬ জনের প্রয়ানের খবর পাওয়া গেলেও পরে সংশোধন করে, বিভাগটি ২৬ জনের প্রয়ানের খবর দিয়েছে। এর আগে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনুসারে, ১৭ মে থেকে ২২ জুন পর্যন্ত মোট ৪২ জন প্রয়াত হয়েছে। বন্যায় প্রয়ানের সংখ্যা দাঁড়াল ৬৮ জনে।