প্রায় পরিবছরই বিভিন্ন উৎসবে নানা রকম বাজি ফুটিয়ে আনন্দ করে থাকেন অনেকেই। তবে তাদের এই নিছক আনন্দের জন্য রীতিমতো দুর্ভোগ পোহাতে হয় কাউকে না কাউকে। আর তা হয়তো তারা এটা বোঝেন না অথবা বোঝার চেষ্টাও করেন না। কিন্তু ধৈর্যেরও একটি সীমা থাকে, সীমা অতিক্রম করলে তা আর মেনে নেওয়া যায় না। নাম শারমিন জামান রেমিন। ছিলেন অনেক মেধাবীও। কিন্তু বছর তিনেক আগে বাজির শব্দে ব্রেইন স্ট্রোক করে বসেন তিনি। এরপর থেকেই বিছানায় পড়ে রয়েছেন শারমিন।
এদিকে আজ মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) দুঃসহ অনুভূতি প্রকাশ করে তার বাবা জাহিদ রিপন বলেন, ‘আমার মেয়েটা ছিল দারুণ মেধাবী। ক্লাস ফাইভ আর এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে এসএসসি পাস করেছিল গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে। আমার সেই সোনার টুকরো মেয়ে এখন অনেক আপনজনকেই চিনতে পারে না। নিছক আনন্দের জন্য কিছু মানুষের ফোটানো বাজির তীব্র শব্দে ভয় পেয়ে ব্রেইন স্ট্রোক করে সে। এতে প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।’
সে যখন এই দুর্ঘটনার শিকার হয় তখন রাতের প্রথম প্রহর। ঘটনা ফরিদপুর শহরের পূর্ব খাবাসপুরের, ২০১৭ সালের জুন মাসে। তখন ছিল রমজান মাস। আর দু-চারদিন পরেই ঈদ। সেই খুশিতে কারা যেন বাসার পাশে বাজি ফোটাতে শুরু করে। বাজির তীব্র শব্দ এসে আঘাত করে বাবার পাশে ঘরে বসে থাকা রেমিনের মস্তিষ্কে। সেই আঘাতেই ভেঙে যায় সাজানো জীবন, তুমুল এক মেধাবীর নানা স্বপ্ন।
‘একটি বাজির শব্দ আমার পরিবারের সারা জীবনের কান্না’, আক্ষেপ করে বলছিলেন জাহিদ রিপন। তিনি বলেন, ‘বাজির শব্দে তছনছ হয়ে গেছে আমার সোনার টুকরো মেয়ের জীবন।’
গণমাধ্যমকর্মী জাহিদ রিপন বলেন, ‘বাজির ঘটনার পর রেমিনের শরীরের একপাশ পুরো প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো তার ডান হাত আর ডান পা প্যারালাইজড। ধরে ধরে হাঁটাচলা করাতে হয়।’
এক সময় চারপাশ মুখরিত করে রাখা রেমিন দুর্ঘটনার সাড়ে চার বছর পরও তেমনভাবে কথা বলতে পারে না বলে জানান তিনি। জাহিদ রিপন বলেন, ‘এখনো সে মানুষ চেনে কম। আমরা যারা কাছে থাকি এর বাইরে দূরের কাউকে চিনতে কষ্ট হয়। স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল, তেমনভাবে কিছু মনে থাকে না।’
‘ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে রেমিন স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হয়েছিল দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফরিদপুরের সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজে। তার স্বপ্ন ছিল সাংবাদিকতা নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করবে। কর্মজীবনে বাবার মতো বেছে নেবে সাংবাদিকতাকে। দশের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের সেবা করবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন বাজির শব্দে গুঁড়ো হয়ে গেছে। সেবার রেমিনের ঈদ কেটেছে হাসপাতালের বেডে বেডে’, বলছিলেন রেমিনের চাচা সোহাগ জামান।
তিনি বলেন, ‘সুস্থ থাকলে এতদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখত রেমিন। নিজেকে প্রস্তুত করতে পারত দেশসেবার জন্য। জীবনের ছবি হতো আলোকোজ্জ্বল। কিন্তু এখন তার সময় কাটে বিছানায় শুয়ে-বসে। জীবন থমকে গেছে। তার জীবনের মতো ফরিদপুরে আনন্দ-উল্লাসের অমানবিক প্রক্রিয়াও আছে অপরিবর্তিত। এখনো নিউ ইয়ার, ঈদ-পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে কারণে-অকারণে বাজি ফোটানো হচ্ছে। আতশবাজি, ফানুস আর শব্দ দূষণ করে মাঝরাতে গান- এসব ভোগান্তি যেন পিছু ছাড়ার নয়। এই চিত্র শুধু ফরিদপুরের নয়, পুরো দেশেরই।’
‘একজনের আনন্দ আরেক জনের সারা জীবনের কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সময় এসেছে এদিকে গুরুত্ব সহকারে নজর দেওয়ার’, বলেন সোহাগ জামান।
রেমিনের বাবা জাহিদ রিপন বলেন, ‘ওই ঘটনার পর মেয়েটা এখন উচ্চ শব্দ নিতে পারে না। ফরিদপুর শহরের পূর্ব খাবাসপুরে আমাদের যে বাড়ি, তার পাশেই রাস্তা। নৈশব্দ বলে কিছু নেই এখানে। মেয়েটা এখানে থাকতে চায় না। তাই জমি বিক্রি করে শহরের বাইরে মুন্সিবাজারে গ্রামের দিকে জমি কিনেছি। শব্দ-সন্ত্রাস থেকে বাঁচতে সেখানে বাড়ির কাজ শুরু করেছি।’
তিনি বলেন, ‘শহর ছেড়ে যেতে আমাদের নানা সমস্যা হবে। কিন্তু তবু যাব, তাতে যদি মেয়েটা একটু স্বস্তি পায়। আমার ক্লাস নাইন পড়ুয়া একটি ছেলে আছে, সেও হয়ত ভালো থাকবে।’
রেমিনের চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহিদ রিপন বলেন, ‘চিকিৎসা চলছে, কিন্তু গত দুই বছর ধরে সেভাবে উন্নতি নেই।’
তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর মেয়েকে তখন ফরিদপুরের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। পরে ঢাকায় এসে প্রফেসর ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদের অধীনে চিকিৎসা করাই। এরপর ভারতের ভেলোরে ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ (সিএমসি) হাসপাতাল নিয়ে যাই। সেখানে যে ডাক্তারের কাছে যাই, গিয়ে শুনি তিনি ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি ড. এরি দে চেকো। দেশে ফিরে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে তার অধীনে রেমিনের অপারেশন করাই। বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে। লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি। কিন্তু দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পরও আমার মেয়েটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি।’
‘ডাক্তাররা বলেন মেয়ে ভালো হয়ে যাবে। তবে সময় লাগবে। কতদিন লাগবে তা কেউ বলতে পারেন না। তারা বলেছেন, এখন রেমিনের ইচ্ছাই সব। সে যা চায়, যা বলে সেভাবেই চলার পরামর্শ দিয়েছেন আমাকে। মেয়ে যদি বলে এখন রাত তাহলে রাত, দিন বললে দিন।’
রেমিনের বাবা বলেন, ‘নতুন যে বাড়ি করছি তার ডিজাইন রেমিনের পছন্দে। সে চায় বাড়িতে সুন্দর বাগান থাকবে, হরিণ থাকবে, পুকুর থাকবে। মেয়ের জন্য একটি পুকুর কেটেছি। কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আমি সামর্থ্যের শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করতে চাই যেন মেয়েটা ভালো থাকে।’
এদিকে চিকিৎসার কাগজপত্র ঘেঁটে জানা যায়, ‘শব্দ দুর্ঘটনায়’ শারমিন যে রোগে ভুগছে তার নাম ‘মোয়ামোয়া’। এর ফলে স্মৃতিশক্তি ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে তার। তবে চিকিৎসকরা আশাবাদি, হয়তো আস্তে আস্তে শারমিন আবারও আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। আর এই দিনটি দেখার অপেক্ষায় দিন কাটছে শারমিনের বাবার।