বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠনের পথে। চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় পরাশক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তারের খেলায় দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, তা কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
এর সর্বশেষ নিদর্শন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে সম্ভাব্য বৈঠক। আজ, শনিবার বা আগামীকাল রবিবার জার্মানির মিউনিখে চলমান নিরাপত্তা সম্মেলনের ফাঁকে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে। বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ উপস্থিত থাকবেন। হাছান মাহমুদ মিউনিখে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন।
নির্বাচনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে গত ৬ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি পাঠান। এতে বিডেন বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে “একত্রে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আন্তরিক ইচ্ছা” ব্যক্ত করেন। মানবিক সমস্যা।
মিউনিখে জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করতে পারেন শেখ হাসিনা মিউনিখে জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করতে পারেন শেখ হাসিনা
চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্যে সমর্থন দিতে এবং একটি উন্মুক্ত ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গিতে অংশীদার হতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
তবে বাংলাদেশের নির্বাচনের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বক্তব্যের সুর ছিল বিডেনের চিঠির থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচন বর্জন করেছে, অভিযোগ করেছে যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ আগের নির্বাচনে কারচুপি ও বিরোধীদের ভয় দেখিয়ে জয়লাভ করেছিল।
সেই সময়, বিডেন প্রশাসন বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার অভিযোগ এনে তাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও বিবেচনা করেছিল। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিডেন প্রশাসনের এই অবস্থান পরিবর্তনের পেছনে একটি প্রধান কারণ হলো তাদের চাপ বাংলাদেশকে চীন-রাশিয়া বলয়ে ঠেলে দিতে পারে, যা আবার যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ভারতের পছন্দ নয়। ধর্ম.
মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মস্কো ও বেইজিংকে সুবিধা দিচ্ছে। দুই দেশই অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। বিডেন প্রশাসনের জন্য এমন পরিস্থিতি কখনই কাম্য নয়।
কুগেলম্যানের মতে, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে ক্ষুব্ধ হলেও শেখ হাসিনা সবসময় ওয়াশিংটনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছেন। কারণ, বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের বড় আমদানিকারক।
যাইহোক, বিডেনের চিঠিতে শেখ হাসিনার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জেলেনস্কির সাথে দেখা করার সিদ্ধান্তের উদাহরণ। রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেনের আত্মরক্ষার বিষয়ে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রচেষ্টা।
একইসঙ্গে এই বৈঠককে বাংলাদেশ-রাশিয়াকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসার চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে। গত বছরের নভেম্বরে রাশিয়ার তিনটি যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়ায় আলোচনা ও অংশগ্রহণ। এ ছাড়া বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে রাশিয়া।
বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্কের মূল্যায়নকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাশিয়ার সহযোগিতার কথা তুলে ধরে বলেন, রাশিয়া আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব শুরু হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনা ও জেলেনস্কির বৈঠকের ফলে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, শেখ হাসিনা একই সঙ্গে একাধিক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় দক্ষতা দেখিয়েছেন এবং কৌশলগত সুবিধা পাওয়ার সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, হাসিনার সম্পর্ক শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এর বাইরে গেলে বোঝা যাবে আমেরিকার অনেক দেশই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।
শেখ হাসিনা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আরও অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে যখন নির্বাচনী দুশ্চিন্তা তৈরি হচ্ছিল, তখন তিনি ফরাসি প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং এয়ারবাসের তৈরি বিমান কেনার জন্য বহু বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে এগিয়ে যান।
আওয়ামী লীগের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) আলী শাহ ফরহাদ বলেছেন, শেখ হাসিনা নিজেকে এমন এক ক্ষমতার জায়গায় নিয়ে গেছেন যেখানে তার বৈচিত্র্য রয়েছে।