বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। বৃহস্পতিবার কণ্ঠভোটে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারকে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগের আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণ করার আহ্বান জানানো হয়।
এছাড়া বেসরকারি সংস্থা, মানবাধিকার কর্মী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ ও অনুকূল কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে যে, ইইউ বাংলাদেশের জন্য ‘ ‘এভরিথিং বাট আর্মসের’ (ইবিএ) পরিসর বাড়ানোর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সনদের লঙ্ঘন করে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মামলা একটি পশ্চাৎপদ পদক্ষেপ, যা উদ্বেগজনক। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইবিএ সুবিধা চালু রাখা উচিত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা। প্রসঙ্গত, ইবিএ প্রোগ্রামের মাধ্যমে জিএসপি সুবিধা প্রদান করা হয়।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাব নিয়ে শুক্রবার কয়েকজন রপ্তানিকারকের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তারা বলছেন, এখনই ইইউর সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু জিএসপি সুবিধা অব্যাহত নিয়ে ইইউ পার্লামেন্টে যে প্রশ্ন উঠেছে তা অবশ্যই অস্বস্তিকর। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবকে সরকারের গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন এসব রপ্তানিকারকরা।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির স্পেশাল ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গৃহীত প্রস্তাব উদ্বেগজনক। মনে রাখবেন, এটি বিচ্ছিন্নভাবে আসেনি। ইইউ কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে এসব বিষয়ে কথা বলেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় এ প্রস্তাব এসেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘ইইউ আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের বড় অংশীদার। তারা বড় বিনিয়োগকারী। এটি ঋণ সহায়তাও প্রদান করে।
ইইউ বাংলাদেশী পণ্যের একটি প্রধান বাজার (মার্কিন একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশী পণ্যের শীর্ষ আমদানিকারক)।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইইউতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫২৩ মিলিয়ন ডলার। ৬ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ বাজারে রপ্তানি হয়েছিল ২ হাজার ১৩৩ মিলিয়ন ডলার। পরের বছর রপ্তানি বেড়েছে ৭ শতাংশ। এরপর করো”নার কারণে রপ্তানি কমেছে। গত অর্থবছর ২০২১-২২ এ এই বাজারে রপ্তানি ঘুরে দাঁড়ায়।
ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির বাজারে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। গত অর্থবছর মোট রপ্তানি ১৩ শতাংশ বা ৭০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় জার্মানিতে। তার পর স্পেনে ৩৬৮, ফ্রান্সে ৩২৯, পোল্যান্ডে ১৮৫, নেদারল্যান্ডসে ২০৯, ইতালিতে ২৩৯, ডেনমার্কে ১৩১ ও বেলজিয়ামে ৯৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।
বাংলাদেশি পণ্যে সবচেয়ে বড় গন্তব্য হলেও ইইউ থেকে আমদানি তুলনামূলক কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছর বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের মোট পণ্য আমদানি ছিল সাত হাজার ৫৬০ কোটি ডলারের। এ আমদানির ২৫ শতাংশ চীন থেকে এসেছে।
ইইউতে বাংলাদেশি পণ্যের মোট রপ্তানির মধ্যে ৯৩ শতাংশই হচ্ছে তৈরি পোশাক। গত অর্থবছর দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে দুই হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের পোশাক, যা মোট পোশাক রপ্তানির ৫০ শতাংশের বেশি। তৈরি পোশাক ছাড়াও এই বাজারে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতা, বাইসাইকেল ইত্যাদি জিএসপি সুবিধার আওতায় পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি হয়।
বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্য হলেও ইইউ থেকে আমদানি তুলনামূলক কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের মোট পণ্য আমদানি হয়েছিল ৭ হাজার ৫৬০ মিলিয়ন ডলার। এসব আমদানির ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত, ১৮ শতাংশ। আর ইইউ থেকে আমদানি ৫ শতাংশের কম।
ইউরোপীয় কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ইইউ বাংলাদেশ থেকে ১,৩৫০ বিলিয়ন ইউরোর আমদানির বিপরীতে মাত্র ২.২২ বিলিয়ন ইউরোর পণ্য রপ্তানি করেছে। তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১,১৩০ বিলিয়ন ইউরো। পরের বছর, ঘাটতি বেড়ে দাঁড়ায় ১২৯০ মিলিয়ন ইউরোতে। ২০২২ সালে সর্বশেষ বাণিজ্য ঘাটতি ২২০০ মিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছেছে।
ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) রয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১১৬ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪১০০ মিলিয়ন ডলারের এফডিআই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ইইউ দেশগুলির মধ্যে, নেদারল্যান্ড থেকে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে, $১২৬ বিলিয়ন।
২০১৯-এর পরেও শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাসের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তবে, ইউরোপীয় কমিশন ২০২৪-৩৪ সালের জন্য নতুন জিএসপি নীতির খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এটি এখনও ইইউ পার্লামেন্ট অনুমোদন করেনি।
ইইজিএসপি প্লাসের খসড়াটি হুবহু ইইউ পার্লামেন্টে অনুমোদিত হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এই সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শর্তেই আটকে যাবে। তখন প্রায় ১২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ইইউতে পোশাক রপ্তানি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র উভয় দেশের উচ্চপর্যায়ে সমঝোতার মাধ্যমেই সম্ভব।
জিএসপি প্লাস না পেলে পোশাক রপ্তানির কী হবে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘জিএসপি সুবিধা না থাকলে ইইউর বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ধস নামবে। কারণ, বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ১-২ শতাংশ দাম কমবেশির কারণে আমরা ক্রয়াদেশ হারাই। সেখানে জিএসপি সুবিধা না থাকলে শুল্কের কারণে তৈরি পোশাকের দাম ১০-১২ শতাংশ বেড়ে যাবে। এই বাড়তি দাম কেন দিতে চাইবে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান।’
বর্তমানে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, উজবেকিস্তান, বলিভিয়াসহ আটটি দেশ ইইউ বাজারে জিএসপি প্লাস উপভোগ করছে। আর বাংলাদেশসহ ৪৬টি স্বল্পোন্নত দেশ জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে।
জানতে চাইলে নিটওয়্যার শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম শুক্রবার রাতে বলেন, ইইউ কখনোই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক ইস্যুকে যুক্ত করেনি। যাইহোক, আমরা এখনও জানি না বিষয়টি কোন দিকে যাচ্ছে। আমরা আশা করি তারা (ইইউ) রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসা মিশ্রিত করবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘পোশাক শিল্পের মাধ্যমে আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছি। আমরা মনে করি, ইইউর নেতৃত্ব চাইবে না এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হোক। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবের কারণে জিএসপি প্লাসের আলোচনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।