বাংলাদেশের অনেক নাগরিক কানাডায় বিপুল পরিমান অর্থ পাচার করে সেখানে বাড়ি গাড়ি করেছেন এবং বিলাসী জীবন যাপন করছেন। যেটা বার বার আলোচনায় উঠে এসেছে। কানাডায় ‘বেগম পাড়া’ নামটি নিয়েও আলোচনা কম নয়। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমান অর্থ পাচার হয় এই দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের কাছে। তবে এবার দেশটির সরকার শুধু বাংলাদেশীদের জন্য নয় সকল দেশের নাগরিকদের জন্য পথটি রুদ্ধ করে দিল।
১ জানুয়ারী কার্যকর হওয়া একটি নতুন আইন বিদেশী নাগরিকদের জন্য কানাডায় আবাসিক সম্পত্তি ক্রয় নিষিদ্ধ করেছে। এই ব্যবস্থা আপাতত ২ বছরের জন্য কার্যকর হবে। আবাসন বাজারের উপর চাপ কমাতে এবং কানাডিয়ানদের জন্য আবাসন আরও সাশ্রয়ী করতে কানাডা সরকার এই ব্যবস্থা নিয়েছে।
আইন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আবারও আলোচনায় এসেছে কানাডার ‘বেগমপাড়া’। এটি বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের অর্থ পাচারকারী, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের কানাডায় দ্বিতীয় আবাসের প্রতীকী নাম।
‘বেগমপাড়া’ নিয়ে একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া হাজার কোটি টাকায় ‘বেগমপাড়া’য় বিলাসবহুল বাসস্থান কেনা হচ্ছে।
‘বেগমপাড়া’র সঙ্গে অর্থ পাচারকারীদের সংযোগ খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে অসাধু বাংলাদেশী ধনী ব্যক্তিদের স্ত্রীরা তাদের স্বামীর পাঠানো অবৈধ টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করে। তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২০০ বাংলাদেশি পাচারের টাকায় কানাডায় বাড়ি কিনেছেন।
কানাডার বিদেশিদের বাড়ি কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় মানি লন্ডারিং অনেকাংশে কমে যাবে বলে মনে করছেন অনেক প্রবাসী।
এভাবে অন্যান্য উন্নত দেশেও যদি বিদেশিদের সম্পত্তি ক্রয় ও বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে ধীরে ধীরে অর্থ পাচার বন্ধ হবে। কারণ, বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্নীতিবাজরা বিদেশি ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার চেয়ে স্ত্রী, সন্তান বা আত্মীয়ের নামে সম্পত্তি কেনা এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ করাকে নিরাপদ মনে করে।
কানাডা সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষণার পর অস্ট্রেলিয়ার নামও আলোচনায় এসেছে। গত কয়েক বছরে সেখানে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অস্ট্রেলিয়াতেও বাংলাদেশের কিছু দুর্নীতিবাজ বাড়ির সন্ধান মিলেছে।
যে কোনো দেশের নাগরিক অস্ট্রেলিয়ায় যেকোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে এবং সম্পত্তি কিনতে পারে। বাংলাদেশের কিছু অর্থ পাচারকারীরা এই সুযোগ নেয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের আফজাল হোসেনের মাসিক বেতন ২৪ হাজার টাকা হলেও তিনি লাখ লাখ ডলার খরচ করে সিডনিতে একটি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। তিনি ইনস্টিটিউট অফ হেলথ টেকনোলজি, ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ (ডিজিএইচএস) এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে আফজাল জানান, সিডনিতে ২ মিলিয়ন ডলারে বাড়িটি কিনেছিলেন তিনি। দুদকের উপ-পরিচালক ও চার সদস্যের তদন্ত দলের প্রধান সামছুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, এ খাতে ব্যয় বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। (সূত্র: অপরাধ বিচিত্রা, জানুয়ারী ১৯,২০১৯)
২০১৯ সালে র্যাব ক্রিকেট বোর্ডের তৎকালীন পরিচালক এবং ২০১৯ সালে ঢাকার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের পরিচালক ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে। সে সময় র্যাব-২ এর কমান্ডিং অফিসার কর্নেল আশিক বিল্লাহ এক প্রেসে বিষয়টি জানান। লোকমান অস্ট্রেলিয়ার এএনজেড ব্যাংক ও কমনওয়েলথ ব্যাংকে ৪১ কোটি টাকা জমা রাখার কথা স্বীকার করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ক্যাসিনো ব্যবসা থেকে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়েছিলেন বলে জানান।
র্যাব কর্মকর্তা আরও জানান, লোকমানের কাছে নগদ ৪১ কোটি টাকা এবং অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে আরও ৩ কোটি টাকার। এই টাকার একটা বড় অংশ এফডিআর হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার দুটি ব্যাংকে জমা করেন তিনি। (সূত্র: ডেইলি স্টার বাংলা, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় কয়েকজন সংসদ সদস্য, অবসরপ্রাপ্ত সা”মরিক কর্মকর্তা, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সন্তানদের নামে বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। তাদের প্রায় সবাই আন্তর্জাতিক ছাত্র। অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক নন। কারও কারও পেট্রোল পাম্প এবং কফি শপ সহ অন্যান্য ব্যবসা রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম এসবিএস নিউজ অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক অর্থনৈতিক ও সম্পত্তি বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলেছে যখন কানাডিয়ান সরকার ১ জানুয়ারিতে বিদেশীদের সম্পত্তি কেনার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তারা অস্ট্রেলিয়ার এই আইন অনুসরণ করার কোন কারণ দেখেননি।
প্রপট্র্যাকের অর্থনৈতিক গবেষণার পরিচালক ক্যামেরন কুশার এই উদ্যোগটিকে ‘জনপ্রিয়’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আবাসন বাজারের আসল সমস্যার একটি ছোট অংশ বিদেশি ক্রেতারা। আমি মনে করি, এটি বলা জনপ্রিয় যে “আমি বাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছি”।’
২০২২ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিক থেকে NAB-এর আবাসিক সম্পত্তি জরিপ রিপোর্ট করেছে যে, বিদেশী ক্রেতারা অস্ট্রেলিয়ান বাজারে জাতীয়ভাবে চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ তৈরি করেছে। ২০১৮ সালে, নিউজিল্যান্ড সরকার বিদেশী নাগরিকদের সম্পত্তি কেনার উপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছিল।
প্রসংগত, বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললেও বিদেশে বাংলাদেশীদের অর্থপাচারের কারণে সেই গতিতে ব্যাপক ভাটা পড়ে। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়, যার নেপথ্যে রয়েছেন দুর্নীতিবাজ এবং ধনিক শ্রেণীর ব্যক্তিরা। তবে সরকার নানাভাবে বিদেশে অর্থপাচার ঠেকাতে কাজ করলেও সেটাতে সফল হতে পারছে না। সরকারের দুর্নীতিবাজ আমলা ও সরকারী কর্মকর্তারা দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারের সহায়তা করছে প্রতিনিয়ত।