দুই সন্তানের জিম্মা নিয়ে মার্কিন বাবা গ্যারিসন লুটেল ও বাংলাদেশি মা ফারহানা করিমের মামলা ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ঢাকার পারিবারিক আদালতকে এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। একই সময়ে, আমেরিকান বাবা গ্যারিসন লুটেল সপ্তাহে দুই দিন তার দুই সন্তানের সাথে দেখা করতে পারবেন বলে আদেশে বলা হয়েছে। অভিভাবকদের একটি সুবিধাজনক স্থানে দেখার সময় নির্ধারণ করতে বলা হয়।
সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
পরে আমেরিকান নাগরিক গ্যারিসন লুটেল বলেন, বাংলাদেশের আদালতে আইনি লড়াই করে আমি সন্তানদের আমার স্ত্রীসহ আমেরিকা নিয়ে যেতে চাই।
আদালতে গ্যারিসনের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফওজিয়া করিম ও ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ আলম। ফারহানা করিমের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
এর আগে, গত বছরের ২৮ নভেম্বর হাইকোর্ট আদেশ দেয় যে আমেরিকান পিতা গ্যারিসন লুটেল সপ্তাহে ২ দিন তার সন্তানদের দেখতে পারবেন। ঢাকার উত্তরা ক্লাবে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার শিশুর মা ফারহানা করিম শিশুকে নিয়ে আসবেন। সেখানে বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত শিশু মায়ের তত্ত্বাবধানেই থাকবেন। সেখানে বাবা গ্যারিসন লুটেল সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন।
বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। ওই দিন আদালতে মার্কিন বাবা গ্যারিসন লুটেল ও বাংলাদেশি মা ফারহানা করিমের জবানবন্দি শুনানি হয়। রুদ্ধদ্বার কক্ষে তাদের বক্তব্য শোনা হয়।
আদালতে শিশুদের বাবা গ্যারিসনের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফওজিয়া করিম ফিরোজ। তাকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ। ফারহানা করিমের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে সন্তানদের কোনো খোঁজ খবর না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ছুটে আসেন গ্যারিসন। বাংলাদেশে আসার পর শিশুদের আদালতে আনার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। ওই রিটের শুনানি নিয়ে বাংলাদেশি মা ফারহানা করিমকে দুই সন্তানসহ আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। উত্তরা থানা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আইনজীবী ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ব্যবসায়ী গ্যারিসন লুটেল। তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফারহানা করিমকে ২০১৮ সালে বিয়ে করেন। ঢাকার উত্তরাতে তাদের বাসা। ফারহানা স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাস করেন। তিন বছর আগে তাদের প্রথম একটি সন্তান হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ফারহানা ও গ্যারিসনের নিজস্ব বাসা ছিল। এ বছরের শুরুর দিকে ফারহানা আবার অন্তঃসত্ত্বা হন। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় জুন মাসে ফারহানা করিম বাংলাদেশে চলে আসেন। অন্তঃসত্ত্বা সময় তার বোন-মায়ের সঙ্গে থাকা জরুরি এই অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশে আসেন। আসার পর তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। সন্তানদের কথা চিন্তা করে গ্যারিসন ফারহানাকে নিয়মিত টাকা দিয়ে আসছিলেন।
কিন্তু পরে দেখলেন, অনেকদিন হয়ে গেছে যোগাযোগ করছে না। কোনো আপডেট দিচ্ছে না। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে তিনি চেষ্টা করেছেন যোগাযোগ করতে, কিন্তু পারেননি। যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে অক্টোবর মাসে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশে আসার পর গ্যারিসন যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু ফারহানা দেখা করতে চান না, বাচ্চারাও দেখাতে চান না। এক পর্যায়ে উত্তরা থানার পুলিশ ও গ্যারিসন যে হোটেলে থাকতেন তাদের সহযোগিতা নিয়ে ফারহানার বাসায় যান। বাসায় গিয়ে জানতে পারেন, ফারহানা করিম কানাডিয়ান একজন ব্যক্তির সঙ্গে বসবাস করছেন। তিনি কানাডিয়ান ওই ব্যক্তিকে বিয়ে করেছেন বলে দাবি করেন। এদিকে, এক মাস আগে আরেকটি ছেলে সন্তান জন্ম দিয়েছেন ফারহানা।
আইনজীবী বলেন, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল তিনি গ্যারিসনকে হাসপাতালের কাগজ দেখিয়েছিলেন যে গ্যারিসনের দ্বিতীয় সন্তান নেই। কাগজ দেখিয়ে বলেছেন দ্বিতীয় সন্তান গ্যারিসনের না। এ সন্তান তার পার্টনার কানাডিয়ান নাগরিকের। তিনি একটা ম্যারেজ ডকুমেন্ট দেখিয়ে বলেছেন, কানাডিয়ান নাগরিককে বিয়ে করেছেন। কিন্তু আমেরিকান নাগরিক গ্যারিসনের সঙ্গে তার এখনো ডিভোর্স হয়নি। গ্যারিসনের বাংলাদেশে আসার অন্যতম কারণ– পুরান ঢাকার একজন কাজী যুক্তরাষ্ট্রে একটি কাগজ পাঠায়। সেটি তালাকের নোটিশ। মুসলিম পারিবারিক আইনে একটি তালাকের নোটিশ পাঠান। নোটিশ দেখে গ্যারিসনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
ব্যারিস্টার সজিব মাহমুদ বলেন, আমরা আদালতকে বলেছি নোটিশটি অবৈধ। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি রাজ্যের আইনে তাদের বিয়ে হয়েছিল। বিবাহবিচ্ছেদ রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা হতে হবে।
বাংলাদেশে আসার পর গ্যারিসন চলে যায় উত্তর সিটি করপোরেশনে। সিটি করপোরেশন থেকে নথিপত্র দেখে তারা বলেন, আসলে এমনটা হয় না। আমরা তখন কাজীর কাছে যাই। তিনি খুব একটা সহযোগিতা করেননি। আমাদের কাছে তার একটা অনুরোধ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী বিবাহিত। তিনি মুসলিম পারিবারিক আইনে নোটিশ পাঠালেও আইনত তা করতে পারেন না। আর নোটিশ জারির সময় ফারহানা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
তিনি বলেন, গর্ভবতী অবস্থায় নোটিশ পাঠানোর সুযোগ নেই। নোটিশের বিষয়ে তিনি একটি দেওয়ানি মামলা করেন। আর শিশুদের হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে হাইকোর্টে হেবিয়ার্স কপার্স রিট করা হয়েছে।