সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিরোধী মতকে দমন নী/পড়ন চালাচ্ছে। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলে ভিন্ন যুক্তি খাড়া করছে। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছে। শুধু তাই নয় দেশের মানুষের বাক স্বাধীনতা হরণ করে তাদের মন্ত্রী-এমপিরা গনতন্ত্রের বড় বুলি ঝাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে সা/মাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্ট্যা/টাস দিয়েছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল পাঠকের জন্য হুবহু নিচে দে/ওয়া হলো।
আমাদের সন্তানেরা কিউট ধরনের। আমাদের এক সন্তানকে শাসন করলেই ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, তুমি নিজে কী? যেমন তাকে যদি বলি, এত রাগী কেন তুমি? উত্তর হচ্ছে, নিজে কী? তার আরেকটা ধরন আছে। দেরি করে বাসায় ফেরার জন্য বকা দিলে বলবে, ওকে (মানে আরেক সন্তানকে) তো সেদিন কিছু বলোনি! কখনো রেজাল্ট খারাপ করলে বলবে, তাকে (সুবিধামতো আরেকজনকে) তো কিছু বলোনি!
তার অভিযোগ অনেকাংশে সত্যি। কিন্তু এ জন্য তাকে বোঝাতে সমস্যা হয় না। তাকে বোঝানো যায়, তোমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, তোমারটার উত্তর দাও। বা বলা যায় ‘ওকে-তাকেও’ সে জন্য বকা দেওয়া হয়েছিল, এখন তোমারটার কথা বলো।
ছোটদের যেভাবে সামাল দেওয়া যায়, বড়দের সঙ্গে তা করা যায় না। আমরা বড়রাও বক্তব্যের বিষয়কে পাশ কাটানোর জন্য এ রকম পাল্টা আক্রমণ করার কৌশল নিই। ‘হোয়াটঅ্যাবাউটিজম’ নামে অভিহিত এই কৌশল শিশুরা গ্রহণ করে অভিমানবশত বা অসহায়ত্ব থেকে।
আমরা পরিণত বয়সের মানুষেরা এটা করি সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বা অপ্রিয় প্রসঙ্গকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। এটি করার জন্য আমরা অনেকে, এমনকি স্রেফ অসত্য কথা বলেও থাকি। শিশুদের আমরা বোঝাতে পারি, কিন্তু এ ধরনের বড়দের বোঝানো যায় না। তাদের অনেক কিছুতে থাকে ‘তখন কী হয়েছিল’(?) বা হোয়াটঅ্যাবাউটিজম আচরণ।
উদাহরণ দিই। কয়েক মাস আগে একটা পত্রিকার অনুষ্ঠানে গেছি। সেখানে সমাজের বিদগ্ধ মানুষেরা আছেন। একটা টেবিলে আমার ঠিক পাশে বসেছেন অতি বিদগ্ধ একজন। অনুষ্ঠানের মূল আলোচক বাংলাদেশের ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের প্রসঙ্গ তুললেন। একপর্যায়ে বললেন, তাদের আদিবাসী বলা যাবে না, সরকার নির্দেশ দিয়েছে—এটা কেমন কথা? তা–ও আবার আওয়ামী লীগের আমলে!
আলোচনা শেষে খাওয়ার টেবিলে মূল আলোচকের বলা আদিবাসী প্রসঙ্গ উঠল। আমি বললাম, তিনি আওয়ামী লীগের আমলে এটি হচ্ছে বলে বিস্মিত হচ্ছেন, অথচ আওয়ামী লীগই তো ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় ভিন্ন জাতিসত্তার পরিচয় নাকচ করেছে, মানবেন্দ্র লারমা এর পক্ষে বলার কারণে তিরস্কৃতও হয়েছেন। অতি বিদগ্ধজন গম্ভীরভাবে বললেন, কিন্তু সামরিক শাসকেরা তো সংবিধানই বদলে দিয়েছেন। আমি দুই বক্তব্যের মধ্যে যোগসূত্র না পেয়ে বললাম, সেটা ঠিক বলেছেন। তবে সামরিক শাসকেরা সংবিধানে ভিন্ন জাতিসত্তা প্রসঙ্গে কোনো যোগ-বিয়োগ করেননি। তিনি মুখ কালো করে বললেন, আমি এসব ব্যাপারে নিরপেক্ষ!
আর কিছু না বলে সেই আলাপে ক্ষান্ত দিই। এ রকম আচরণ আমিও হয়তো করি কোনো না কোনো আলাপে, বিতর্কে। অন্যরা করলে আমি বিস্মিত হই। আমার এমন আচরণে নিশ্চয়ই অন্যদের এমন প্রতিক্রিয়া হয়। তবে আমরা সাধারণ মানুষ, আমরা একটু রয়েসয়ে এটা করি। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা যখন করেন, তখন তা চলে যায় তিক্ততার পর্যায়ে, এর ক্ষতিকর অভিঘাত হয় অনেক বেশি।
২.
রাজনীতিবিদেরা হোয়াটঅ্যাবাউটিজম করেনও খুব বেশি। যেমন বিএনপিকে মাগুরা উপনির্বাচন নিয়ে অভিযোগ করা হলে বলা হতো, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে কী হয়েছিল? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রশ্ন তোলা হলে বলা হতো আওয়ামী আমলে রক্ষীবাহিনীর কথা। বর্তমান আমলে গুমের অভিযোগ তোলা হলে বলা হয়, জিয়ার সময় অভ্যুত্থানের অভিযোগে সামরিক বাহিনীর লোকদের ‘গুম’ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করা হলে বলা হয়, জিয়ার আমলে হ্যাঁ-না ভোটের নির্বাচনী তামাশা হয়েছিল!
রাজনৈতিক নেতাদের এই নিরন্তর কাদা-ছোড়াছুড়িতে আরও উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁদের অনুসারীরা। আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে দুঃখ প্রকাশ করলে বলা হয়, সনি হত্যাকাণ্ডের সময় কই ছিলেন? কর্নেল তাহেরের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে বলা হয়, সিরাজ সিকদার ‘হত্যাকাণ্ডের’ সময় কই ছিলেন। কোনো বক্তব্য বা অভিযোগ নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা নেই, আছে শুধু পাল্টাপাল্টি অভিযোগের কাদা–ছোড়াছুড়ি।
এই প্রবণতা বিষাক্ত করে তুলছে সমাজকে। অথচ ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে বোঝা যাবে, নিজে কী বা আগে কী হয়েছিল—এসব প্রশ্ন অবান্তর নয়, কিন্তু বর্তমান সময়ে কী করা হচ্ছে, তার জবাব চাওয়া এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা মূলত বর্তমানে বাস করি। ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য অতীতের চেয়ে বর্তমান বেশি মূল্যবান। অতীত কেউ আনডু বা রিডু করতে পারেন না, একটু সচেতন হলে বর্তমানের ক্ষেত্রে তা করা যায়।
হোয়াটঅ্যাবাউটিজম নিয়ে আমাদের তাই নতুন করে ভাবার প্রয়োজন আছে।
৩.
হোয়াটঅ্যাবাউটিজম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বেও। একসময় তাদের পক্ষ থেকে এই প্রবণতার অভিযোগ তোলা হতো স্নায়ুযুদ্ধকালের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। বলা হতো, দেশটির বিরুদ্ধে ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন, আফগানিস্তানে আক্রমণ, পোল্যান্ডে সামরিক শাসনে মদদ—এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করা হতো দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসন, দক্ষিণ আমেরিকায় হস্তক্ষেপ বা ট্রেড ইউনিয়নকারীদের গ্রেপ্তারের অতীত ইতিহাস তুলে।
সোভিয়েত যুগ শেষ হওয়ার পর হোয়াটঅ্যাবাউটিজমের অবসান হয়েছে ভাবা হতো। তবে পুতিনের উত্থানের পর তা যে কীভাবে বর্তমান রাশিয়ায় ফিরে এসেছে, তা আমরা ইউক্রেনে দেশটির আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে দেখতে পাই। ২০১৬ সালে ক্রিমিয়া দখলের সমালোচনার জবাবে পুতিন বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের অতীত প্রসঙ্গ তুলেছিলেন।
সম্প্রতি পারমাণবিক বোমার হুমকি দেওয়ার সময় তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্রই এর সূচনা করেছিল বলে স্মরণ করিয়ে ভীতিকর বার্তা দেন। ক্রিমিয়া দখল বা পারমাণবিক হুমকি আন্তর্জাতিক আইনে গুরুতর অপরাধ, এটি ঢাকতে এই পাল্টা আক্রমণের কৌশল বিশ্বের জন্য স্বস্তিকর বলে বিবেচিত হয়নি।
পাশ্চাত্যের অভিযোগমতো হোয়াটঅ্যাবাউটিজম রাশিয়াই শুধু করে থাকে, তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বা নব্য কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়ার শাসকদেরও এই কৌশল ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তবে বাংলাদেশের মতো সর্বক্ষেত্রে, সব সময় এর ব্যবহার পৃথিবীর খুব কম দেশেই হয়।
৪.
বাংলাদেশে হোয়াটঅ্যাবাউটিজমের ব্যবহার হয় মূলত কুশাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন আর দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগকে পাশ কাটানোর জন্য, ভিন্নমত বা সমালোচনাকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য। এখন আবার এসবে নতুন মাত্রাও যোগ হয়েছে। আমাদের দেশে গুম নিয়ে অভিযোগ তুললে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, অন্য দেশে কী হচ্ছে? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলে ইউরোপ–আমেরিকাকে শুনিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাদের দেশে কত মানুষ এভাবে মারা যাচ্ছে। এমনকি ভুয়া নির্বাচন নিয়ে দেশে কেউ প্রশ্ন তুললে বলা হচ্ছে, ২১ আগস্টের সময় আপনারা কই ছিলেন?
এসব পাল্টা অভিযোগ তোলা একদমই যুক্তিহীন, তা নয়। তবে এখানে কিছুটা কার্যকারণ সম্পর্ক ও সত্যতা অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে গুম হিসেবে যা বর্ণনা করা হয়, তা আসলে সত্য নয়। সরকারি বাহিনী কর্তৃক কাউকে লোপাট করে দেওয়া আর নিজে নিজে পরিবার ছেড়ে চলে যাওয়া এক নয়। সবচেয়ে বড় কথা, সেখানে গুম বা পুলিশের গুলিতে মানুষ মারা গেলে বিচার করা হয়, এ নিয়ে সরকারপ্রধানসহ সরকারের যে কাউকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে পারে বিরোধী দল, গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ।
সত্যতার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাও। যেমন ২১ আগস্ট ঘটেছে বলে ভুয়া ভোটের পক্ষে কেন যুক্তি দেওয়া হবে? দেশের সংবিধান ও আইনে ২১ আগস্টের হোতাদের বিচার সাপেক্ষে চরম শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু সে জন্য ঢালাওভাবে বিরোধী দলের মিছিল-সমাবেশে গুলি করার বা তাদের কাউকে গুম করার কোনো বিধান নেই। বিধান নেই এ জন্য দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে শাস্তি দেওয়ার।
হোয়াটঅ্যাবাউটিজমের মাত্রা নিয়ে আমাদের তাই ভাবতে হবে। না হলে বাংলাদেশের সরকারগুলোর ন্যূনতম জবাবদিহিও আর থাকবে না।
প্রসঙ্গত, সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে একের পর অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিপক্ষে কথা বললে তার ওপর নানা কৌশলে দমন করা হচ্ছে মন্তব্য করেন ড. আসিফ নজরুল । তিনি বলেন, সরকার ক্ষমতা ছাড়া কিছু বোঝে না।